১৯২৯-এর মহামন্দা এবং সমকালীন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রভাব – ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা যায়, যা সাধারণভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দা নামে পরিচিত। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই বিপর্যয়ের সূত্রপাত হলেও ক্রমশ তা সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
সুস্বাগতম প্রিয় শিক্ষার্থী। Prayaswb-এর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের সঙ্গে ১৯২৯-এর মহামন্দা এবং সমকালীন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো।
তো চলুন আজকের মূল বিষয় ১৯২৯-এর মহামন্দা এবং সমকালীন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রভাব পড়ে নেওয়া যাক।
১৯২৯-এর মহামন্দা এবং সমকালীন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রভাব
 |
১৯২৯-এর মহামন্দা এবং সমকালীন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রভাব |
১৯২৯-এর মহামন্দা এবং সমকালীন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রভাব
১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা যায়, যা সাধারণভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দা নামে পরিচিত। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই বিপর্যয়ের সূত্রপাত হলেও ক্রমশ তা সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব-ইতিহাসে এ ঘটনা ছিল অভূতপূর্ব।
মহামন্দার সূচনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাময়িক বিপর্যয়ের পর বিশের দশক থেকে মার্কিন অর্থনীতি প্রবলভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকে। মার্কিন রাজনীতিকরা মনে করতেন যে, মার্কিন অর্থনীতির এই তেজীভাব চিরস্থায়ী- এর কোনো পরিবর্তন হবে না। ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রপতি হুভার ঘোষণা করেন যে, তাঁর মাতৃভূমি নানা সম্পদে সমৃদ্ধ এবং এই দেশের ভবিষ্যৎ নতুন আশা-আকাক্ষায় সমুজ্জ্বল। তাঁর ক্ষমতায় আসার ছয় মাসের মধ্যে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের মার্কিন শেয়ার বাজারে ধস নামে। ১৯২৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াল স্ট্রিটের বাজারে শেয়ার বিক্রি কিছুটা কমে যায়। গুজব রটে যে বাজারের তেজীভাব শীঘ্রই কমে আসছে। এর ফলে বাজারদর কমার আগেই সবাই শেয়ার বিক্রির জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। ২৪শে অক্টোবর, (যা ‘কালো বৃহস্পতিবার’ নামে পরিচিত) শেয়ার-মালিকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে থাকে এবং ওই দিন ৩ কোটি শেয়ার কেনাবেচা হয়। ২৯শে অক্টোবর আরও ১ কোটি ৩৫ লক্ষ শেয়ার হাত বদলায়। শেয়ার বাজারে হাহাকার পড়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা তেজীভাব দেখে শেয়ার বাজারে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল, তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। ব্যাংকগুলি শেয়ার বাজারে বহু অর্থ লগ্নি করেছিল। তারা বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মানুষের ধারণা হয় ব্যাংক অপেক্ষা নিজের বাড়িতে টাকা রাখা অনেক নিরাপদ। এই ধারণায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ব্যাংক থেকে তাদের টাকা তুলে নেওয়ার জন্য ছুটতে থাকে। ব্যাংকগুলিতেঅত টাকা না থাকায় ব্যাংকগুলি চিরতরে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমেরিকা থেকে এই মন্দা ভূমিকম্পের মতো বিশ্বের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
মহামন্দার কারণ
এই মহমন্দার জন্য নানা কারণকে দায়ী করা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভোগ্যপণ্য, খাদ্যশস্য ও শিল্পদ্রব্য রপ্তানি করত। এই চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে আমেরিকায় খাদ্যশস্য ও শিল্পদ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধশেষে ইউরোপীয় দেশগুলি নিজ নিজ শিল্প ও খাদ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিলে আমেরিকার রপ্তানি বাণিজ্যে ঘাটতি দেখা দেয়। মার্কিন শিল্পপতিরা অতি লাভের আশায় উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে প্রচুর পণ্যাদি উৎপাদন করেছিলেন। কিন্তু তার সবটা দেশীয় বাজারে বিক্রি হত না। এর ফলে বছরের পর বছর ধরে অবিক্রিত পণ্যাদি দেশে জমতে থাকে, শিল্পপতিরা উৎপাদন কমিয়ে দেন। এর ফলে শ্রমিকের সংখ্যাও কমান হয় এবং বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। যুদ্ধ, ঋণ পরিশোধ ও পণ্য ক্রয় বাবদ ইউরোপ থেকে প্রচুর সোনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে হত। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সোনা মার্কিন ধনভাণ্ডারে জমা পড়ত। যারা মার্কিন মাল কিনত বা মার্কিন ঋণ পরিশোধ করত, তাদের স্বর্ণভাণ্ডার ক্রমে শূন্য হয়ে যায়। তারা নতুন করে মার্কিন পণ্য ক্রয় বা ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ে। এর ফলে মার্কিন পণ্যের বিক্রিও বন্ধ হয়ে যায়। তাদের পণ্যাদি গুদামে পচতে থাকে। এছাড়া, মন্দা দেখা দিলে বিভিন্ন দেশ তাদের যেটুকু সোনা আছে তা বাঁচাবার জন্য শুল্ক প্রাচীর তুলে আমদানি বন্ধ করার চেষ্টা করলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভয়াবহ মন্দা দেখা দেয়। • তেজিভারের সময় শিল্পপতিদের লাভ ছিল ৭২%, কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে মাত্র ৮%। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলি পণ্যমূল্যও হ্রাস করে নি, বা শ্রমিকদের মজুরিও আশানুরূপ বৃদ্ধি করে নি। এর ফলে অবিক্রীত পণ্যের পাহাড় জমতে থাকে, অথচ লক্ষ লক্ষ মার্কিনীর অনেক প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ছিল না। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং পণ্যমূল্য হ্রাস করে অনায়াসেই বাজারের তেজীভাব ধরে রাখা যেত। নিজ দেশের শিল্পগুলিকে রক্ষার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি পণ্যের আমদানির ওপর অতিরিক্ত হারে শুল্ক আরোপ করে। অনুরূপভাবে, বহু ইউরোপীয় রাষ্ট্রও আমেরিকান পণ্যের ওপর উচ্চহারে আমদানি শুল্ক আরোপ করে। এর ফলে মার্কিনি পণ্যের বিক্রি বন্ধ হয়।
মহামন্দার প্রভাব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে : এই মহামন্দার প্রভাব ছিল ব্যাপক। এর ফলে ১৯২৯ থেকে ১৯৩২-এর মধ্যে আমেরিকায় ৫৭০০ টি ব্যাংক ফেল করে এবং আরও ৩৫০০টি ব্যাংক তাদের কাজকর্ম বন্ধ রাখে। মহামন্দা শুরুর দু-মাসের মধ্যে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা ৪ হাজার কোটি ডলার হারায় এবং ব্যাংক-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় আমানতকারী জনসাধারণ সর্বস্বান্ত হয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলি ব্যাংকের ঋণ থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি না হওয়ার ফলে কারখানাগুলিও একে একে বন্ধ হয়ে যায় এবং শ্রমিকরাও বেকার হয়ে পড়ে। কৃষিপণ্যের মূল্যও ভয়াবহভাবে হ্রাস পায় এবং লক্ষ লক্ষ কৃষক জমি হারিয়ে ভিখারির অবস্থায় পৌঁছয়। অবস্থা সামাল দেবার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রপতি হারবার্ট ক্লার্ক হভার (১৯২৯-৩৩ খ্রিঃ) কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
- তিনি শিল্পপতি ও নিয়োগকারীদের শ্রমিক-বেতন হ্রাস ও তাদের ছাঁটাই না করার নির্দেশ দেন।
- দেশকে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সরকার ব্যাংক, শিল্পপতি ও কৃষকদের ঋণ দেয়।
- বেকারত্ব দূর করার উদ্দেশ্যে রাস্তাঘাট ও সরকারি ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্য সরকার প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করে।
- সরকার ‘পুনর্নিমাণ অর্থ করপোরেশন’ গঠন করে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির উদ্দেশ্যে তিন বছরের জন্য ঋণদানের ব্যবস্থা করেন।
এইসব ব্যবস্থার দ্বারা আমেরিকার আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। ১৯৩২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট (Franklin Delano Roosevelt) অতি সহজেই জয়ী হন।
ইউরোপে
মহামন্দার ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যে সব দেশের সঙ্গে আমেরিকার আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক ছিল তারাই সমস্যায় পড়ে এবং তাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমেরিকা বা ইউরোপীয় দেশগুলির কোনো অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। এর ফলে রাশিয়া বেঁচে যায়।
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালে ইউরোপীয় দেশগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচুর ঋণ নিয়েছিল। যুদ্ধের অবসানে জার্মানি আমেরিকা থেকে ঋণ নিয়ে মিত্রপক্ষকে ক্ষতিপূরণ দিত এবং নিজের দেশের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটাত। জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ আমেরিকার কাছে তাদের যুদ্ধকালীন ঋণ মেটাত। মহামন্দা সব কিছুই বানচাল করে দেয়।
- মহামন্দার ফলে আমেরিকা জার্মানিকে ঋণদান বন্ধ করলে জার্মানির পক্ষেও ক্ষতিপূরণের অর্থপ্রদান অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেন ক্ষীণ হয়ে যায়।
- জার্মান-অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে মার্কিন ঋণের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই জার্মান অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। জার্মানির বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বেকার সমস্যা তীব্রতর রূপ ধারণ করে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জার্মানি থেকে পুঁজি তুলে নেয়। এই শোচনীয় আর্থিক বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনি ক্ষমতায় আসেন। ফ্রান্স ও অন্যান্য কয়েকটি দেশ ক্ষতিপূরণ পাবার আশায় আগেই সেই বাবদ প্রাপ্য অর্থ খরচ করে ফেলেছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স গভীর সঙ্কটের সম্মুখীন হয়।