ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের কারণগুলি আলোচনা করো
অথবা, পণ্যদশ শতাব্দীতে ইউরোপের সামরিক ক্ষেত্রে যে বিপ্লব হয়েছিল, তার পটভূমি আলোচনা করো

ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের কারণসমূহ
ইউরোপে পঞ্চদশ শতক হল সামরিক বিপ্লবের সূচনার যুগ। এই পর্ব থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ, বন্দুক ও কামানের ব্যবহার, সামরিক কৌশলের পরিবর্তন ছিল লক্ষণীয়। সামরিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল বিভিন্ন কারণে। নিম্নে এই সামরিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পটভূমি বা কারণগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
(1) যুদ্ধাস্ত্রে বাবুদের ব্যবহার: ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের মূলে ছিল বারুদের ব্যবহার। সম্ভবত খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে চিনে প্রথম বারুদের আবিষ্কার হয়েছিল। যদিও জেফ্রি পার্কারের মতে, সোরা, কাঠকয়লা ও গন্ধকের সংমিশ্রণে চিনে বারুদের আবিষ্কার ঘটেছিল নবম শতক নাগাদ। পরবর্তীতে আরব বণিকদের মাধ্যমে বারুদ নির্মাণের কলাকৌশল ইউরোপে আসে। চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতক থেকে নির্মিত হতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্র, যা অচিরেই রণক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
(2) ধাতুশিল্পের উন্নতি: যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র নির্মাণে লোহা, ব্রোঞ্জ ও অন্যান্য ধাতুর প্রয়োজন ছিল। ইউরোপে এই সময় উপযুক্ত গুণসম্পন্ন ধাতুর জোগান বৃদ্ধি পেলে ধাতুশিল্পের উন্নতি ঘটে। এর প্রভাব সামরিক ক্ষেত্রেও পড়েছিল। ধাতুশিল্পের উন্নতির ফলে কামান ও গোলার ব্যবহার যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকরী হয়ে ওঠে।
(3) নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রসমূহের জয়লাভের আকাঙ্ক্ষা: আলোচ্য পর্বে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেমন- স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানিতে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের উত্থান ঘটে। এই সময় যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সকল দেশই নিজ নিজ রাষ্ট্রসীমা সম্প্রসারণের জন্য যুদ্ধে জয়লাভের আশা করত। এজন্য সব পক্ষই সামরিক শক্তিবৃদ্ধি ও সামরিক উৎকর্ষতার প্রতি দৃষ্টি দেয়।
(4) যুদ্ধের প্রয়োজনে পদাতিক বাহিনীর সংস্কার: পঞ্চদশ শতক থেকেই সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহী বাহিনীর তুলনায় পদাতিক বাহিনীর গুরুত্ব ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধের প্রয়োজনে ইউরোপের বহুদেশ পদাতিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ, রণকৌশল ও আকারগত উন্নতিতে দৃষ্টি দেয়। বৃদ্ধি পায় সমরাস্ত্রের ব্যবহার।
(5) রাজশক্তির সমর্থন: যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীর গঠন ও অস্ত্র নির্মাণ ছিল ব্যয়বহুল। রাজশক্তির সমর্থন ছাড়া এই কাজ করা সম্ভবপর ছিল না। কৃষি, বাণিজ্যের উপর কর বসিয়ে রাজারা যে অর্থের জোগান দিতেন, তা দিয়ে সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র নির্মাণ সম্ভবপর হয়েছিল।
(6) অস্ত্রের গুণগতমান বৃদ্ধি: ইউরোপীয় যুদ্ধক্ষেত্রে এই সময় অস্ত্রের গুণগতমান বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে ক্রেসি (Crecy)-এর যুদ্ধে ইংল্যান্ড ৬ ফুট লম্বা ধনুক (Long Bow) এবং বিশেষ ধরনের পালক বাঁধা তির ব্যবহার করে ফ্রান্সের সুসজ্জিত অশ্বারোহী বাহিনীকে পরাস্ত করে। এরপর ইউরোপে যুদ্ধে বারুদ ও কামানের ব্যবহার শুরু হলে সামরিক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সুতরাং, Necessity is the Mother of Invention (প্রয়োজনই হল আবিষ্কারের জননী) – এই আপ্তবাক্যটি সামরিক বিপ্লবের ক্ষেত্রেও যে সমানভাবে প্রযোজ্য, তা বলাই যায়। আর উপরোক্ত পটভূমির উপর ভিত্তি করেই যে ইউরোপে নতুন নতুন যুদ্ধকৌশল ও সমরাস্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যুগান্তর আসে, সেই সত্যকেও অস্বীকার করা যায় না কোনোভাবেই।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর