দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের প্রসার (Class 11 Exclusive Answer)

দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের প্রসার – দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের সূচনা ও প্রসারের পথিকৃৎ ছিলেন আলবার ও নায়নার সাধক-সাধিকাগণ। এঁরা তামিল ভাষায় আঞ্চলিক পৌরাণিক কাহিনি ও কিংবদন্তির মিশ্রণে সাধারণ মানুষকে সহজ-সরলভাবে ধর্মশিক্ষা দান করতেন। এই দুই সম্প্রদায়ের সন্তরা বিভিন্ন জায়গা পরিভ্রমণ করেন এবং সংগীতের মাধ্যমে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে প্রত্যক্ষ ভালোবাসার সম্পর্কের কথা প্রচার করেন।

দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের প্রসার

দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের প্রসার
দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের প্রসার

দক্ষিণ ভারতের ডক্তিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ

অতি প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদী আন্দোলনের অস্তিত্ব ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, দাক্ষিণাত্যে ভাগবত পুরাণ থেকেই ভক্তিবাদের বিকাশ ঘটেছিল। এখানে যে ভক্তিধারা বিকশিত হয়েছিল, তার বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

  • দক্ষিণে জৈন ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কঠোরতার কারণে ভক্তিবাদের উত্থান ঘটে।
  • ভক্তি আন্দোলনকারীরা নিজেদের দাবি করতেন ঈশ্বর ও সাধারণ মানুষের মধ্যস্থতাকারী রূপে।
  • দক্ষিণ ভারতে পল্লবদের মতো স্থানীয় রাজাগণ ভক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ভক্তিবাদীদের সমর্থন করেছিলেন। সামাজিক স্থায়ীত্ব আনতে, বাণিজ্য ও কৃষিতে উন্নতি ঘটাতে তৎকালীন প্রশাসকগণ মন্দির নির্মাণ এবং সেগুলিকে অঢেল উপঢৌকন ও ভূমিদান করতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পল্লবরাজ মহেন্দ্রবর্মণ জৈন মঠ ধ্বংস করেন এবং জৈন সন্ন্যাসীদের বিতাড়ন করেন।
  • দক্ষিণের ভক্তিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মহিলা সাধিকাদের আবির্ভাব। এ প্রসঙ্গে বিয়ুর ভক্ত আন্ডাল-এর পাশাপাশি শিবের ভক্ত কারাইক্কল আম্মাইয়ার (নায়নার)-এর নামও বিশেষভাবে স্মরণীয়।

আলবার ও নায়নার সাধক-সাধিকাদের ভূমিকা

দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের সূচনা ও প্রসারের পথিকৃৎ ছিলেন আলবার ও নায়নার সাধক-সাধিকাগণ। এঁরা তামিল ভাষায় আঞ্চলিক পৌরাণিক কাহিনি ও কিংবদন্তির মিশ্রণে সাধারণ মানুষকে সহজ-সরলভাবে ধর্মশিক্ষা দান করতেন। এই দুই সম্প্রদায়ের সন্তরা বিভিন্ন জায়গা পরিভ্রমণ করেন এবং সংগীতের মাধ্যমে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে প্রত্যক্ষ ভালোবাসার সম্পর্কের কথা প্রচার করেন।

জাতিভেদের বিরোধিতা: অনেকের মতে, আলবার ও নায়নার সাধকরা সমাজে প্রচলিত জাতি ভেদাভেদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। লক্ষণীয় যে, এই সাধকেরা নানা সামাজিক শ্রেণি থেকে এসেছিলেন। ব্রাহ্মণ, কারিগর, কৃষক এমনকি অস্পৃশ্যদের মধ্য থেকেও ভক্তিবাদী সাধকদের আবির্ভাব ঘটেছিল। এঁরা জাতিভেদ প্রথার প্রতিবাদ করেন এবং ব্রাহ্মণদের সামাজিক আধিপত্যের অবসান দাবি করেন।

শংকরাচার্য, রামানুজ এবং মাধবাচার্য

দক্ষিণ ভারতে আলবার ও নায়নার ভক্তিবাদী সাধকদের প্রচেষ্টায় বিষ্ণু ও শিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় প্রায় নিষ্প্রভহয়ে যাওয়া হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা। আসলে ভক্তিবাদী সাধকদের সহজ-সরল ধর্মমতের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে হিন্দু সংস্কারকরাও হিন্দু ধর্মদর্শনের জটিলতা ও অস্পষ্টতা দূর করে তাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- শংকরাচার্য, রামানুজ ও মাধবাচার্য।

শংকরাচার্য

শংকরাচার্য আনুমানিক অষ্টম শতকের শেষ বা নবম শতকের গোড়ার দিকে কেরলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বৈদিক দর্শনের সহজ ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেন।

মতবাদ : শংকরাচার্য ছিলেন অদ্বৈতবাদের প্রবক্তা। তাঁর মতে, ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্ট এই জগৎ এক ও অভিন্ন। বেদান্ত বা উপনিষদই অদ্বৈতবাদের উৎস।

রচনাসমূহ: শংকরাচার্য ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য, বিবেক চূড়ামণি, গীতাভাষ্য ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি পুরী, শৃঙ্গেরি, দ্বারকা ও হিমালয়ে মঠ স্থাপনও করেছিলেন।

রামানুজ

ভক্তিবাদের আদি প্রবক্তাদের মধ্যে রামানুজ (১০১৭-১১৩৭ খ্রি.) ছিলেন অন্যতম। তিনি মধ্যযুগের বৈয়ব ভক্তিবাদের প্রাণপুরুষ নামে পরিচিত।

প্রথম জীবন: আলবার সাধক যামুনাচার্যের উত্তরাধিকারী এই প্রচারক শ্রীপেরুমবুদুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং গুরু যাদব প্রকাশের কাছ থেকে বেদ অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে গমন করেন কাঞ্চিতে। শিক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন হলে তিনি গৃহত্যাগী হন এবং শ্রীরঙ্গমের জ্যোতিরাজ নামের এক সন্ন্যাসীর থেকে বৈয়ব মতে দীক্ষা নেন। এরপর তামিলনাড়ুর শালিগ্রামম নামক স্থানে তিনি দীর্ঘ ১২ বছর বৈয়ব মত প্রচার করার পর সমগ্র ভারত ভ্রমণ করেন।

মতবাদ: রামানুজের দর্শন বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত। তাঁর মতে ব্রহ্মের দুটি অংশ চিৎ (জীবাত্মা) ও অচিৎ (জড়জগৎ)। শংকরাচার্যের মতের বিরোধিতা করে বলেন, ‘জ্ঞান মুক্তির অন্যতম একটি পথ, একমাত্র পথ নয়।’ রামানুজ মুক্তির জন্য ভক্তির উপরই বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। তবে এই ভক্তি ঈশ্বরের কীর্তন-ভজন নয়, বরং ঈশ্বরের ধ্যান বা প্রার্থনা।

রচনাসমূহ: রামানুজের লেখা বেশ কয়েকটি রচনা হল-শ্রীভাষ্য, গীতাভাষ্য, বেদান্তসংগ্রহ ইত্যাদি। রামানুজ ছিলেন শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের (প্রবক্তা: নাথমুনি বা রঙ্গনাথাচার্য, তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদানকারী: যামুনাচার্য) আচার্য। তিনি ভক্তিবাদ ও হিন্দু দর্শনের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছিলেন।

মাধবাচার্য

দ্বাদশ শতকের একজন বিশিষ্ট ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক ছিলেন মাধবাচার্য তথা মঞ্চ (১১৯৯-১২৭৮ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি পূণ্যপ্রজ্ঞা বা আনন্দতীর্থ নামেও পরিচিত।

প্রথম জীবন: দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক অঞ্চলের উডুপিতে মাধবাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। অচ্যুত প্রেক্ষানন্দের কাছে দীক্ষা নেন তিনি। প্রথম জীবনে শৈব থাকলেও পরে তিনি বৈয়ব ধর্মে দীক্ষিত হন। দক্ষিণ ভারতের শৃঙ্গেরি শারদা পীঠে তিনি জগদ্‌গুরু পদে আসীন ছিলেন।

মতবাদ: মাধবাচার্য ছিলেন দ্বৈতবাদের মুখ্য প্রবক্তা। তাঁর মতে, এই বিশ্বের প্রত্যেক পরমাণুতেই প্রাণ আছে, অর্থাৎ প্রত্যেক পরমাণুই জীব। ব্রহ্ম বা ঈশ্বর এবং জীবাত্মা হল দুটি আলাদা সত্তা।

রচনাসমূহ: মাধবাচার্য ভগবদ্গীতা, ঋকবেদ ও কেন উপনিষদের ভাষ্য রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি হল সর্বদর্শনসংগ্রহ। মাধবাচার্যের চার শিষ্য (পদ্মনাভতীর্থ, মাধবতীর্থ, নরহরিতীর্থ, অক্ষোভ্যতীর্থ) কর্তৃক প্রবর্তিত সম্প্রদায় ব্রহ্ম সম্প্রদায় নামে পরিচিত।

আরও পড়ুনLink
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তরClick Here
তেলেনাপোতা আবিষ্কার বড় প্রশ্ন উত্তরClick Here
আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তরClick Here

Leave a Comment