প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সভ্যতা বিকাশের সম্পর্ক কী ছিল

প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সভ্যতা বিকাশের সম্পর্ক কী ছিল

অথবা, সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন যুগে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সম্পর্কে আলোচনা করো

প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সভ্যতা বিকাশের সম্পর্ক কী ছিল
প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সভ্যতা বিকাশের সম্পর্ক কী ছিল

প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সভ্যতা বিকাশের সম্পর্ক

প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সভ্যতা বিকাশের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়কালে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও অগ্রগতি সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রখ্যাত মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ গেরহার্ড লেনস্কি (G Lenski) ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ যথার্থই বলেছেন যে, মানবসভ্যতার অগ্রগতির প্রাথমিক উপাদান ছিল প্রযুক্তির উদ্ভাবন।

(1) বিভিন্ন সময়কালের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি:

  • প্রাচীন কালের প্রযুক্তি: প্রাচীন কালে মানুষ তার অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনে বুদ্ধি খাটিয়ে প্রযুক্তির উদ্ভাবনে সচেষ্ট হয়। সেযুগে বনচারী, পশুশিকারী মানবসমাজ তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের কাজে রত ছিল। যেমন- লাঠির ডগা দিয়ে মাটি খুঁড়ে বীজ রোপণ করা, নানা ধরনের হাতিয়ার তৈরি করা এবং তাকে উন্নততর ও কার্যকরী রূপ দেওয়া প্রাচীন কালের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের অন্যতম দৃষ্টান্ত। আবিষ্কারের পাশাপাশি আদিম মানবের যুগান্তকারী একটি আবিষ্কার হল চাকা। এই চাকা আবিষ্কারের ফলশ্রুতিতে মৃৎশিল্প, ধাতু ও বয়নশিল্প, কৃষিকাজ ইত্যাদি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে মানুষ ধাপে ধাপে এগিয়ে চলে। বিশিষ্ট মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজতাত্ত্বিক লিউস হেনরি মরগ্যান (Lewis Henry Morgan) মনে করেন যে, আদিম সভ্যতা, বর্বরতা এবং সভ্যতা সামাজিক বিবর্তনের এই তিনটি পর্যায় যথাক্রমে তিনটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন (আগুন, তিরধনুক, মৃৎপাত্র)-এর সঙ্গে জড়িত ছিল। আর এই তিনটি পর্যায়ে মানুষ বনের পশুকে পোষ মানানো, চাষবাস, ধাতুবিদ্যা এবং লিপির উদ্ভাবন প্রক্রিয়ার সাক্ষী আগুন হয়েছিল। এর পরবর্তীতে সভ্যতা গড়ে ওঠার যুগে ভারত, গ্রিস, চিন ইত্যাদি দেশে মানুষের প্রযুক্তির ব্যবহার উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ- হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা, জল নিষ্কাশন প্রযুক্তি, দূরপাল্লার জাহাজ নির্মাণ ও বন্দর স্থাপনের কথা বলা যায়। গ্রিসে আবিষ্কৃত হয় জলশক্তি ও বায়ুশক্তির প্রযুক্তি। এ ছাড়া চিনদেশে লোহার লাঙল, কাগজ, চুম্বকীয় কম্পাস ও বারুদ নির্মাণশৈলীও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্বরূপ।
  • মধ্যযুগের প্রযুক্তি: মধ্যযুগের প্রযুক্তির বিকাশের গতি মন্থর ছিল। তবে মধ্যযুগেও বেশকিছু প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটে। এই সময় কৃষি প্রযুক্তির কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হল- ভারী লোহার ফলাযুক্ত লাঙল, জলকল বা Water Mill এবং বায়ুকল বা Wind Mill, ও মধ্যযুগের শেষের দিকে আরবদের হাত ঘুরে চিনদেশ থেকে বারুদ তৈরির জ্ঞান ইউরোপে এলে আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে ইউরোপের সামরিক ক্ষেত্রে তা অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটায়। এ ছাড়া মেরিনারস কম্পাস, আতস কাঁচ, ঘড়ির আবিষ্কার এই সময়কালের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন।
  • রোনসী ও তার পরবর্তী কালপর্বে প্রযুক্তি: পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে নবজাগরণের কালপর্বে গ্যালিলিও, কেপলার প্রমুখের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আধুনিক বিজ্ঞানকে করেছিল সমৃদ্ধ। এরপর চার্লস বয়েল, আইজ্যাক নিউটন, হামফ্রে ডেভি, জেমস ওয়াট-এর সময়েও বিজ্ঞানসাধনা ও বিভিন্ন উদ্ভাবনের সেই ধারা প্রবহমান ছিল। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি তথা কারিগরি ব্যবস্থার উন্নয়নে এসেছিল জোয়ার, যাকে Technological Revolution বা কারিগরি বা প্রযুক্তি বিপ্লব বলা হয়। এর ফলে কৃষিক্ষেত্র, সামরিক ক্ষেত্র, নৌযাত্রা, ধাতুর ব্যবহার ইত্যাদিতে নব নব উন্নত প্রযুক্তির আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, সভ্যতার বিকাশ ও প্রযুক্তির উন্নয়ন অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে গ্রথিত। নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রয়োগ মানবসভ্যতা এবং জীবনধারাকে দ্রুত ও নিরাপদে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment