ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রের ভূমিকা লেখো

ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রের ভূমিকা
ইউরোপে সামরিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রের গুরুত্ব ছিল অসীম। বস্তুত চতুর্দশ শতকের গোড়া থেকেই ইউরোপে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও বন্দুক নির্মাণের সূচনা হয়েছিল বলে জানা যায়।
(1) উন্নত প্রযুক্তিতে নির্মিত আগ্নেয়াস্ত্র: আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের পূর্বে সৈনিকরা তিরধনুক, তলোয়ার, বল্লম, কুঠার- এই জাতীয় অস্ত্রের সাহায্যে যুদ্ধ করত। কিন্তু পঞ্চদশ শতক থেকে ইউরোপীয় রণক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেতে থাকে কামান ও বন্দুকের ব্যবহার। ক্রমে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র আরও উন্নতরূপ ধারণ করে।
- বন্দুক: ইউরোপে আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণের প্রথম যুগে হাতবন্দুকের কথা জানা যায়। চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে সিসার গুলি আর তির ছোঁড়ার জন্য যথাক্রমে ২৪ পাউন্ড ও ৩৪ পাউন্ড ওজনের বন্দুক ব্যবহৃত হত। এ ছাড়া প্রায় ১ টন ওজনের বন্দুকেরও উল্লেখ মেলে। কিন্তু ধীরে ধীরে বন্দুক নির্মাণের প্রযুক্তিতে আসে পরিবর্তন। হাতে বহন করে চালানো যায় এরকম বন্দুক ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি শুরু হয় উন্নতমানের নলযুক্ত নতুন পিস্তলের ব্যবহার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে নির্মিত হয় আর্কেবুস (Arquebus) বন্দুক। ষোড়শ শতকে সেনাবাহিনীর হাতে আসে মাস্কেট (Musket)। এই জাতীয় বন্দুকের নল (Barrel) লোহা দিয়ে তৈরি হত এবং এর কুঁদো (Butt) ছিল কাঠের। এগুলি প্রায় ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হত। মাস্কেটগুলির ওজন ছিল ১৫ পাউন্ড এবং এগুলি থেকে নির্গত সিসার বুলেট প্রায় ২০০ গজ দূর পর্যন্ত নিক্ষিপ্ত হত। ওই শতাব্দীতে স্পেনে নাবিকদের মধ্যে মাস্কেট বা গাদাবন্দুকের ব্যবহার লক্ষ করা গিয়েছিল।
- কামান: কামান ছিল সামরিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে অপর এক গুরুত্ববাহী অস্ত্র। বারুদের সাহায্যে কামান দেগে পাথরের গোলা ছুঁড়ে শত্রুপক্ষের দুর্গদ্বার ভাঙা হত। ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দের একটি দলিলে কামানের দ্বারা দুর্গের প্রাকার ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিরা দুটি অতিকায় কামান থেকে প্রায় ৩ ফুট ব্যাসবিশিষ্ট এবং ৮০০ পাউন্ড ওজনের পাথরের গোলা নিক্ষেপ করে গুঁড়িয়ে দেয় কনস্ট্যান্টিনোপলের রক্ষাপ্রাচীর। বস্তুত কামানের শক্তিতেই শতবছরের যুদ্ধে হারফ্ল্যর সমেত নর্ম্যান্ডির প্রায় ৭০টি ইংরেজ অধিকৃত এলাকা ফ্রান্স দখল করে নিয়েছিল। ১৪৮০-র দশকে অধিকার করেছিল কাস্তিল গ্রানাডা ও ব্রিটানি।
- যুদ্ধ জাহাজ: শুধু স্থলযুদ্ধেই নয়, সামরিক বিপ্লবের কালে ইউরোপীয় জলযুদ্ধেও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। আলোচ্য পর্বে শেষ হয়ে আসছিল ভাইকিং জলদস্যুদের মন্থরগতি জাহাজের দিন। বরং জলদস্যুদের প্রতিহত করতে সেযুগে জাহাজের উপর সরাসরি কামান বসিয়ে তাকে যুদ্ধোপযোগী করে তোলার দিকে নজর দেওয়া হয়।
(2) গুরুত্ব: পরিশেষে বলা যায় যে, আগ্নেয়াস্ত্র সামরিক বিপ্লবের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল।
- আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা যেমন অনেক দূর থেকে সহজেই যে-কোনো দক্ষ যোদ্ধাকে হত্যা করা সম্ভব হয়, তেমনই গোলা-গুলির আঘাতে একই সঙ্গে হনন করা যায় বহু শত্রুর প্রাণ।
- আগ্নেয়াস্ত্রের বহুল ব্যবহারের ফলে প্রবল পরাক্রমী নাইটদের গৌরব সূর্য অস্তমিত হয়। বৃদ্ধি পায় পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনীর গুরুত্ব।
- পাশাপাশি কামান, বন্দুক ক্রমে হয়ে উঠেছিল রাজশক্তির অস্ত্র। যেসব রাষ্ট্র শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্র এবং প্রশিক্ষিত বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়, তারা নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে তুলতে এবং নতুন অঞ্চলসমূহ দখল করতে সমর্থ হয়। কাজেই আগ্নেয়াস্ত্রকে কেবল যুদ্ধে জয়লাভের ক্ষেত্রেই নির্ণায়ক রূপে চিহ্নিত করা চলে না বরং ইউরোপীয় সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিতেও যে এর গুরুত্ব প্রশ্নাতীত তা স্বীকার করতেই হয়।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর