অভিপ্রায়ের বিভিন্ন রূপগুলি কী তা উল্লেখ করো – আজকের পর্বে অভিপ্রায়ের বিভিন্ন রূপগুলি কী তা আলোচনা করা হল।
অভিপ্রায়ের বিভিন্ন রূপগুলি কী তা উল্লেখ করো
![]() |
অভিপ্রায়ের বিভিন্ন রূপগুলি কী তা উল্লেখ করো। |
অভিপ্রায়-এর বিভিন্ন রূপ
অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি তাঁর ‘A Mannual of Ethics’ নামক গ্রন্থে অভিপ্রায়-এর বিভিন্ন রূপের উল্লেখ করেছেন। এই সমস্ত রূপ বা আকারগুলিকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল-
তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারীরূপে অভিপ্রায়
ম্যাকেঞ্জি অভিপ্রায়কে তাৎক্ষণিক (Immediate) এবং সুদূরপ্রসারী (Remote) রূপে উল্লেখ করেছেন। ধরা যাক, একজন দুষ্কৃতি নদীতে ঝাঁপ দিল। তখন কোনো সাধারণ ব্যক্তি বা পুলিশের অভিপ্রায় হল নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওই ডুবন্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা। অর্থাৎ তাৎক্ষণিকভাবে যে বিষয়টি করা উচিত বলে মনে করা হয়, তাই হল তাৎক্ষণিক অভিপ্রায়। কিন্তু, এই তাৎক্ষণিক অভিপ্রায় ছাড়াও ওই পুলিশ কর্মীর একটি দূরবর্তী অভিপ্রায়ও থেকে যায়। এই দূরবর্তী অভিপ্রায়ের মাধ্যমেই পুলিশ কর্মীটি চায় বিচারের মাধ্যমে দুষ্কৃতিটির শাস্তি হোক। অর্থাৎ যে বিষয়টি ভবিষ্যতের বিষয় বলে গণ্য, তাকেই বলা হয় দূরবর্তী অভিপ্রায় বা সুদূরপ্রসারী অভিপ্রায়।
বাহ্য ও আন্তররূপে অভিপ্রায়
অভিপ্রায় বাহারূপেও গণ্য হতে পারে, আবার তা আন্তররূপেও হতে পারে। যে অভিপ্রায়কে বাহ্যদৃষ্টিতে বিচার করা হয়, তাকেই বলা হয় বাহ্য অভিপ্রায় (Outer Intention)। অপরদিকে, যে অভিপ্রায়কে আন্তরদৃষ্টিতে বিচার করা যায়, তাকেই বলা হয় আন্তর অভিপ্রায় (Inner Intention)। এরূপ অভিপ্রায় দুটিকে বোঝানোর জন্য ম্যাকেঞ্জি আব্রাহাম লিঙ্কনের একটি শূকরছানাকে গর্ত থেকে উদ্ধারের ঘটনাটিকে উল্লেখ করেছেন। আব্রাহাম লিঙ্কন একদিন একটি শূকরছানাকে গর্তে পড়ে ছটফট করতে দেখে, তাকে উদ্ধার করেন। কারণ তিনি শূকরছানার যন্ত্রণা দেখে নিজেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, শূকরছানাকে তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্যই তিনি তাকে উদ্ধার করেন এবং এটাই হল তাঁর বাহ্য অভিপ্রায়। কিন্তু যখন তিনি স্বীকার করেন যে, শূকরছানার যন্ত্রণাক্লিষ্টতার জন্য তাকে উদ্ধার করা হয়নি, নিজের অস্বস্তিকর যন্ত্রণাক্লিষ্টতা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তাকে উদ্ধার করেছেন, তখন তা হল তার আন্তর অভিপ্রায়।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষরূপে অভিপ্রায়
অভিপ্রায়কে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ- এই দু-ভাগে ভাগ করা যায়। ধরা যাক, কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে কোনো উগ্রপন্থীদল। তার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের ভ্রমণরত আকাশযানটিকে তারা ধ্বংস করতে চায়। সেই ক্ষেত্রে ওই রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করাই হল তাদের প্রত্যক্ষ অভিপ্রায় (Direct Intention)। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আর যে-সমস্ত নিরপরাধ ব্যক্তি আকাশযানে রয়েছেন, তারাও তার সঙ্গে মারা যেতে পারে। তাদের হত্যা করার কোনো অভিপ্রায় উগ্রপন্থীদের নেই। অথচ রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে তাদেরও হত্যা করতে হবে। এরূপ অভিপ্রায়টিকেই বলা হয় পরোক্ষ অভিপ্রায় (Indirect Intention)।
চেতনাসম্পন্ন ও অচেতনাসম্পন্নরূপে অভিপ্রায়
অভিপ্রায়কে আবার চেতনাসম্পন্ন ও অচেতনাসম্পন্নরূপেও উল্লেখ করা যায়। অবশ্য স্বীকার করা যায় যে, অভিপ্রায়ের এরূপ বিভাজনটি যত না নীতিসম্পন্ন, তার চেয়ে অনেক বেশি মনোবিজ্ঞানসম্মত। অচেতনাসম্পন্ন অভিপ্রায় হল তাই, যাকে কর্মকর্তা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করে না। সেটি তাই মনের মধ্যেই সুপ্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, জনগণের হিতার্থে অর্থদানের অর্থ হল জনগণের মঙ্গলের জন্য অর্থব্যয় করা। এখানে জনগণের মঙ্গল করা হল কর্মকর্তার চেতনাসম্পন্ন অভিপ্রায়। কিন্তু এর পশ্চাতে যদি তার ধর্মপ্রচারের অভিপ্রায় থাকে, তাহলে তাকে বলা হয় অচেতনাসম্পন্ন অভিপ্রায়। নীতিবিজ্ঞানী লিলি অবশ্য এরূপ অচেতনাসম্পন্ন অভিপ্রায়কে নীতিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করেননি।
আকারগত এবং বস্তুগত অভিপ্রায়
অভিপ্রায়কে আবার আকারগত Formal) এবং বস্তুগত (Material) রূপেও শ্রেণিবিন্যাস করা যায়। আকারগত অভিপ্রায় হল সেই অভিপ্রায় যেখানে একটি নির্দিষ্ট নীতিকে অনুসরণ করে, ক্রিয়াটিকে সম্পন্ন করা হয়। অপরদিকে, বস্তুগত অভিপ্রায় হল তা-ই যা একটি নির্দিষ্ট ফল বা পরিণামকে সূচিত করে। ধরা যাক, দুজন নাগরিক কোনো সরকারের পতন চায়। একজন পতন চায় অতিরিক্ত প্রগতিশীল বলে, আর অপরজন পতন চায় অতিরিক্ত মৌলবাদী বলে। এক্ষেত্রে এই দুজন নাগরিকের আকারগত অভিপ্রায় ভিন্ন ভিন্ন হলেও তাদের বস্তুগত অভিপ্রায় কিন্তু একই।
সুতরাং দেখা যায় যে, অভিপ্রায় শব্দটিকে নীতিবিজ্ঞানে অত্যন্ত ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে এবং তার রকমফের-এর বিষয়টিকে স্বীকার করাও হয়েছে। অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি তাই বলেন-অভিপ্রায় শব্দটি কোনো ঐচ্ছিক ক্রিয়ার সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে বোঝায় যাকে অনিবার্যভাবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা অবশ্যই বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে (An intention, in the broadest sense of the term, means any aim that is definitely adopted as an object of will; and that such intentions may be of various distinct kinds J. S. Mackenzie: A Manual of Ethics, P-50) |