 |
ইংল্যান্ড ও মহাদেশের শিল্পবিপ্লবের তুলনামূলক আলোচনা করো
|
শিল্পবিপ্লব প্রথম শুরু হয় ইংল্যান্ডে এবং তারপর তা ধীরে ধীরে ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি, রাশিয়ায় বিস্তৃত হয়। তারও পরে সুইডেন, স্পেন, অস্ট্রিয়া, স্যাক্সনি, বোহেমিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডের শিল্পায়নের সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য দেশের শিল্পায়নের কিন্তু যথেষ্ট পার্থক্য ছিল।
কাঁচামাল সংগ্রহ ও ভোগ্যপণ্য বিক্রির বাজার
আঠারো শতকের শেষভাগে যখন ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল, তখন কিন্তু ইউরোপের অন্যান্য অংশে ঐ বিপ্লব আসে নি। মহাদেশে শিল্পবিপ্লব হয়েছিল আরও ত্রিশ-চল্লিশ বছর পরে এবং তাও আবার ব্রিটিশ আদলে নয়। প্রথম শুরু হওয়ায় ইংল্যান্ডকে যে-সব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশকে সে-সব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। আবার ইংল্যান্ড কিছু সুবিধাও পেয়েছিল, যা অন্যান্য দেশ পায়নি। ইংল্যান্ডকে প্রথমদিকে কোনো প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়নি। প্রথমে ইউরোপ এবং পরে সমগ্র বিশ্ব-জুড়ে তার একাধিপত্য ছিল। ‘পর্যাপ্ত’ কাঁচামালের যোগান এবং উদ্বৃত্ত শিল্পসামগ্রি বিক্রির ‘বাজার’ ছাড়া শিল্পবিপ্লব হয় না। ভারত ও আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে ইংল্যান্ড এই সমস্যা মিটিয়েছিল।
ইংল্যান্ড ইউরোপের শিক্ষক
অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা যে ইউরোপের অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের চেয়ে উন্নতমানের ছিলেন, তা নয়। কিন্তু ইংল্যান্ডের পরপর কয়েকটি আবিষ্কার, যেমন- জন কে-র ‘উড়ন্ত মাকু’, আর্করাইটের ‘ওয়াটার ফ্রেম’, জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় শক্তির আবিষ্কার ইংল্যান্ডে একটি অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ইংল্যান্ডের প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো অনুসরণ করেই তাদের দেশে শিল্পোন্নয়ন শুরু করে। এইসব দেশের প্রযুক্তিবিদরা ইংল্যান্ডে এসে শিক্ষা নিতেন এবং নিজেদের দেশে ইংল্যান্ডের যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়ে শিল্পোন্নয়নের চেষ্টা করতেন। ইংল্যান্ডই ছিল তাঁদের ‘মডেল’ বা আদর্শ। ইংল্যান্ডের বিশেষজ্ঞদের তাঁরা নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশে শিল্পোন্নয়ন ঘটাতেন।
ইংল্যান্ডে দীর্ঘ প্রস্তুতি
ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের পশ্চাতে ছিল দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি। চারটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন অষ্টাদশ শতকের শেষে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। সেগুলি হল- জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে-বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, বাণিজ্যিক বিপ্লব, পরিবহণ বিপ্লব। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা অভাবনীয়রূপে বৃদ্ধি পায়। শিল্পবিকাশের ওপর এর প্রভাব পড়ে। গোটা সপ্তদশ শতক ধরে ইংল্যান্ডের বাণিজ্য বৃদ্ধি- বিশেষ করে ঔপনিবেশিক বাণিজ্যবৃদ্ধি ইংল্যান্ডের অর্থনীতিতে জোয়ার আনে। কৃষি বিপ্লব মানুষের হাতে পুঁজি জমতে সাহায্য করে। এছাড়া কৃষি উৎপাদন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সরবরাহ করেছিল। আবার কৃষিকার্যে উদ্বৃত্ত শ্রমিক শহরে চলে গিয়ে নতুন শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল না। অনেক দেশেই গণ বিপ্লব ও পরিবহণ বিপ্লব ঘটলেও কৃষি বা বাণিজ্য বিপ্লব ঘটে নি। ইংল্যান্ডে পুঁজিপতি বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব হলেও ইউরোপের অন্যান্য দেশে তা হয় নি।
ইংল্যান্ডে ব্যক্তিগত বণিকদের উৎসাহ দেওয়া হত
ইংল্যান্ডে সরকার প্রত্যক্ষভাবে শিল্পবিপ্লব ঘটায় নি। ইংল্যান্ড-সরকার অবাধ বাণিজ্য নীতিতে বিশ্বাস করত এবং ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও উদ্যমকে উৎসাহ দিত। বিচক্ষণ সরকার শিল্প-বিকাশের সহায়ক অর্থনীতি গ্রহণ করে এবং উপনিবেশ বিস্তার দ্বারা নতুন নতুন ‘বাজার’ সৃষ্টির চেষ্টা করে। অন্যদিকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে শিল্পায়নে ব্যক্তিগত উদ্যোগের অভাব ছিল। ফ্রান্সের শিল্পায়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রথম দেখা যায় লুই ফিলিপের আমলে (১৮৩০-৪৮ খ্রিঃ)। জার্মানিতে শিল্পে জোয়ার আসে জার্মানির ঐক্যের পরে। রাশিয়ার শিল্পায়নে সরকারি উদ্যমই ছিল সব।
সংরক্ষণ নীতি
শিল্প প্রসারের ক্ষেত্রে ‘সংরক্ষণ নীতি’ অতি গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি প্রতিযোগিতার হাত থেকে দেশের শিল্পকে রক্ষার জন্য উনিশ শতকের শেষদিকে প্রত্যেকটি দেশই সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করেছিল। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে বিসমার্ক সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করেন। ফ্রান্স ১৮৯২-এ ‘শুল্ক আইন’ প্রবর্তন করে ইংল্যান্ড-জাত দ্রব্যের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক চাপায়। ইংল্যান্ড ছিল শিল্পবিপ্লবের পথিকৃৎ। ইংল্যান্ডের উন্নতমানের পণ্যাদি যাতে দেশি শিল্পের উন্নতির পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় এজন্যই জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করে এবং এই সংরক্ষণ নীতি ছিল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে।
রেলপথ নির্মাণ
রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রেও ইংল্যান্ড ও মহাদেশের চিত্র পৃথক। শিল্প বিপ্লবের আদিপর্বে ইংল্যান্ডে রেলপথ ছিল না। শিল্পায়নের অনেক পরে উনিশ শতকের বিশের দশকে ইংল্যান্ডে রেলপথ নির্মিত হয়। কাঁচামাল ও শিল্পজাত দ্রব্যাদির দ্রুত গমনাগমনের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের শিল্পপতিরাই রেলপথ নির্মাণ করে- এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল না। ইউরোপের অন্যান্য দেশে রেলপথ নির্মিত হয় শিল্পবিপ্লবের অনেক আগেই এবং এটি হয়েছিল সরকারি উদ্যোগে। জাতীয় নিরাপত্তা বিধান, সেনাদলের গমনাগমন, জাতীয় উন্নয়ন প্রভৃতি কারণে সরকার রেলপথ নির্মাণ করে। ইংল্যান্ডে শিল্পের প্রয়োজনে ব্যক্তিগত পুঁজির দ্বারা রেলপথ নির্মিত হয়। আর অন্যান্য স্থানে রেলপথের হাত ধরে শিল্পায়নের জয়যাত্রা সূচিত হয় এবং সেখানে পুঁজির যোগানদার ছিল রাষ্ট্র।
শিল্পায়নে বিভিন্ন দেশের গতি অসমান
শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সব দেশে শিল্পোন্নয়নের গতি সমান ছিল না। ইংল্যান্ডে যখন শিল্পের প্রসার শুরু হয়, তখন মহাদেশের অন্যান্য অনেক দেশে সামন্ততন্ত্র প্রচলিত। ইউরোপের সর্বত্রই শিল্প-বিকাশের গতি ছিল শ্লথ। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড- দুই দেশে একই সঙ্গে শিল্পায়ন শুরু হলেও ফ্রান্স কিন্তু ইংল্যান্ডের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। ফরাসি বিপ্লব ও নেপোলিয়নের সামরিক অভিযানগুলি ফ্রান্সে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল। মোটামুটিভাবে ১৮০০ থেকে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফ্রান্সে শিল্পায়ন শুরু হয়, তবে তার গতি ছিল মন্থর। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির ঐক্য সাধনের পর সেখানে শিল্পায়নের গতি আসে। ১৮৬০-এর সূচনায় রাশিয়ায় শিল্পায়ন শুরু হয়, যদিও তা গতি পায় উনিশ শতকের শেষ দশকে।