ইলেকট্রনিক বর্জ্য: সমস্যা ও প্রতিকার রচনা

ইলেকট্রনিক বর্জ্য: সমস্যা ও প্রতিকার রচনা
ইলেকট্রনিক বর্জ্য: সমস্যা ও প্রতিকার রচনা

ভূমিকা

আমাদের পরিবেশকে নষ্ট করার অন্যতম প্রধান উপাদান হল আমাদেরই তৈরি বর্জ্য পদার্থ। এই বর্জ্য পদার্থ কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় যে কোনো প্রকৃতির হতে পারে। ইলেকট্রনিক বর্জ্য হল কঠিন বর্জ্য-যা দূষণ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বর্জ্য পদার্থের উৎপাদন যেহেতু রোধ করা যায় না, তাই বর্জ্য পদার্থের সঠিক অপসারণের (disposal) বা পুনরাবর্তনের (recycling) দিকে বিশেষ লক্ষ রাখা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা ও সরকারি ভূমিকা সমস্যা সমাধানে বিশেষ সহায়ক হতে পারে।

বর্জ্য কী?

ইলেকট্রনিক বর্জ্য হল পরিত্যক্ত কম্পিউটার, অফিসের ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, মোবাইল ফোন, টিভি সেট, ফ্রিজ প্রভৃতি যেগুলি পুনরায় ব্যবহার, বিক্রয়, পুনরাবর্তন প্রক্রিয়ার দ্বারা গ্রহণ বা নষ্ট করার জন্য রাখা হয়। এছাড়া যেসব ইলেকট্রনিক দ্রব্য পুনরায় মেরামত করে গ্রহণ করার জন্য রাখা হয় তা-ও ই-বর্জ্য। সেইসঙ্গে কিছু গৌণ বস্তু যেমন, তামা, স্টীল, প্লাস্টিক প্রভৃতিও ই-বর্জ্য। বৃহত্তর অর্থে ই-বর্জ্য হল সমস্ত অব্যবহার্য ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যাদি। ক্যাথড রে টিউব (CRT) যা সীসা ও ফসফরাস সমন্বিত তাও এই শ্রেণির বর্জ্য।

সৃষ্টির কারণ

ইলেকট্রনিক পণ্যদ্রব্য কোনটি এবং বর্জ্য কোনটি সেই সংজ্ঞা নিয়েও বিতর্ক আছে এবং সেই বিতর্কের মধ্যেই রয়েছে ই-বর্জ্য সৃষ্টির কারণ। যেমন কিছু এই শ্রেণির রপ্তানীকারক ইচ্ছাকৃতভাবে পুরোনো দিনের সরঞ্জাম ব্যবহার করেন, মেরামত করা যায় না বা পুনরাবর্তন প্রক্রিয়ায় আনা যাবে না এমন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন কিম্বা অত্যাধুনিক সাজসরঞ্জাম ব্যবহার না করে ইলেকট্রনিক বর্জ্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁরা মনে করেন, যে কোনো উপায়ে বাজার দখল করাটাই তাঁদের কাজ, পরবর্তীকালে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে তা তাঁদের চিন্তাভাবনার বাইরে থাকে। ফলে তাঁদের প্রস্তুত ইলেকট্রনিক পণ্য কিছু দিনের মধ্যেই বর্জ্যতে পরিণত হয়। দ্বিতীয়ত, বেশ কিছু পুরোনো ইলেকট্রনিক দ্রব্যের সরঞ্জাম ব্যবহার করে (ল্যাপটপ, ডেস্কটপ প্রভৃতির সরঞ্জাম) কম দামে বাজার দখল করতে গিয়ে ই-বর্জ্যকে বাড়িয়ে তোলেন। ‘ঘানা ই-ওয়েস্ট কান্ট্রি অ্যাসেসমেন্ট’ (Ghana E-waste Country Assessment)-এর ২০১১-র রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে যে ২১৫০০০ টন ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ নতুন ব্র্যান্ড এবং ৭০ শতাংশ ব্যবহৃত দ্রব্য ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ঐ ৭০ শতাংশ ব্যবহৃত দ্রব্যের মধ্যে ১৫ শতাংশ পুনর্বার ব্যবহৃত সরঞ্জাম। সুতরাং ই-বর্জ্য সৃষ্টির কারণ সহজেই অনুমেয়।

সমস্যা

প্রযুক্তিবিদ্যার আধুনিকীকরণ জনিত কারণে, মানুষের চাহিদার দ্রুত পরিবর্তনের ফলে ইলেকট্রনিক দ্রব্যের চাহিদারও পরিবর্তন ঘটছে-যার ফলে সমস্যাও তীব্রতর হচ্ছে। সমস্যা ধনী দেশগুলিও উন্নতমানের ইলেকট্রনিক দ্রব্যের উৎপাদন ঘটিয়ে পৃথিবীব্যাপী নতুন চাহিদা সৃষ্টি করায় পুরাতন ল্যাপটপ, এল সি ডি, এল ই ডি মনিটর, প্রসেসরস (সিপিইউ, চিপস্, র‍্যাম) বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। এমনকি এইসব দ্রব্য সারিয়ে নেওয়া বা সামান্য মেরামত করে গ্রহণ করার মানসিকতাও মানুষের মধ্যে কম থাকায় ই-বর্জ্য বেশি করে সৃষ্ট হচ্ছে। প্রতি বছর পৃথিবীতে ৫৫ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে-যার মধ্যে আমেরিকার রয়েছে ৩০ মিলিয়ন টন। ইউরোপে ১০০ মিলিয়ন ফোন প্রতিবছর পরিত্যক্ত হচ্ছে বর্জ্য হিসেবে। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পুনরাবর্তন প্রক্রিয়ায় নতুন সরঞ্জামে পরিণত হয়। ভারতবর্ষেও আগামী দিনে কম্পিউটার ও ফোন বর্জ্য হিসেবে ভয়ঙ্কর সমস্যা সৃষ্টি করবে। চিন ই-বর্জ্য সৃষ্টিতে আমেরিকার পরেই রয়েছে। এমনকি আমেরিকার ই-বর্জ্য চিনে পৌঁছে যাচ্ছে জাহাজে-যা দিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে নতুন সরঞ্জাম-যা কিছুদিনের মধ্যে পুনরায় ই-বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। পুনর্নবীকরণ-এর ক্ষেত্রে হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশু কাজ করছে যারা আবার দূষণেরও শিকার। প্রতি ১০টি শিশুর মধ্যে ৭জনের রক্তে সীসা পাওয়া গেছে-যারা এই ই-বর্জ্য পুনর্নবীকরণ কারখানায় কাজ করে।

সমাধান

বিজ্ঞানকে যথাযথ ব্যবহার না করতে পারলে তার অভিশাপ যে নেমে আসবে তা বলাবাহুল্য। আমেরিকার মতো ধনী দেশ সুকৌশলে অন্য দেশে ই-বর্জ্য পাঠিয়ে দিতে পারে কিম্বা উপগ্রহে তা রেখে আসতে পারে কিন্তু ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই ই-বর্জ্য তো মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করবে। তাই সমাধানের জন্য প্রয়োজন সরকারের দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা ও তার রূপায়ন এবং সর্বোপরি প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা।

উপসংহার

মানুষ যেভাবে যান্ত্রিক হচ্ছে এবং যন্ত্রনির্ভরতাকে প্রগতি বলে বিচার করছে, নতুন নতুন পণ্যদ্রব্যের ভোগের প্রতি যেভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে তাতে এধরনের সমস্যা নিরসনের প্রধান উপায় হল কোনো জিনিস গ্রহণ বা ব্যবহার করার আগে ভেবে দেখা সংশ্লিষ্ট জিনিসের সুফল ও কুফল কী কী। সেই ভাবনা চিন্তাই পারে ই-বর্জ্যের মতো সমস্যার নিরসন ঘটাতে।

Leave a Comment