একটি বর্ষার দিন রচনা

একটি বর্ষার দিন রচনা
একটি বর্ষার দিন রচনা

ভূমিকা

আলো ও অন্ধকারের মতো মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ নিত্যসঙ্গী। এমনই সুখ-দুঃখে ভরা একটি বর্ষার দিন স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। দিনটা ছিল সোমবার। সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি। ভোর হওয়ার অনেক আগে থেকেই আকাশ ছিল ঘন মেঘে আচ্ছন্ন। গতদিন রেডিওতে বারবার ঘোষিত হচ্ছিল নিম্নচাপের পূর্বাভাষ। হলও তাই। দিনটা সোমবার হওয়ায় স্কুলে যাওয়া হবে না-এমন একটা আশঙ্কা মনের মধ্যে দানা বাঁধছিল। মেঘের গর্জনে আকাশ ফেটে পড়ছিল-‘গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি/গরজে গগনে গগনে।’ গলা ছেড়ে গান গাইছিলাম- ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে, গগনে গগনে ডাকে দেয়া’। সত্যিই, তারপর সেদিন যা হল তা এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

প্রস্তুতি ও আবির্ভাব

আমি যে বর্ষণমুখর দিনের কথা জানাতে চাইছি, সেদিনটা ত কাল বর্ষণের মতো। কেননা শীত এসে গিয়েছে। মাঠে মাঠে ধান তোলার পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। কৃষকরা মহা আনন্দে ধান কেটে তা গোলাজাত করার কাজে ব্যস্ত। মূলো, পালং, বাঁধাকপি, ফুলকপি, আলু প্রভৃতি কৃষিখন্দ ফলানোর প্রস্তুতিও শেষ। এমন সময়ে বৃষ্টি কার ভালো লাগে। আবার বৃষ্টি নয়, দিনভর বৃষ্টি। নিম্নচাপের ফলে এই সময়ে এত বর্ষণ তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। বেলা যত বাড়তে থেকেছে ততই বৃষ্টির দাপট বেড়েছে। সুয্যিদেব কখন আকাশে উঠেছে তা বোঝার উপায় ছিল না। আকাশ জুড়ে কালো মেঘের জাজিমে জমজমাট আসরের প্রস্তুতি যে এত ভয়াবহ হবে তা অনুমান করতে পারিনি।

বর্ষা শুরু

বর্ষণ শুরু হতেই বুঝলাম, আজকের দিনটা মাটি হয়ে গেল। স্কুলে যেতে হবে না ভেবে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। তাই মাকে খিচুড়ি রান্না করার কথা বললাম। মা তো ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। কারণ সম্বৎসরের ধান মাঠে পড়ে রয়েছে, এমনিতেই সকলের চিন্তায় মুখ ভার, তারপর আমার বায়না আগুনে ঘি দিয়ে দিল। পরে বুঝতে পারলাম, আমার অমন বায়না ঠিক হয়নি। কারণ কারো পৌষমাস, কারো সর্বনাশ। যাই হোক্-খিচুড়ির বায়না ছেড়ে লেপ মুড়ি দিয়ে বিছানা নেব ভাবলাম। এই অকাল বর্ষণ শীতকালের শীতটাকে বাড়িয়ে দিল। বিছানায় আবার শরীরখানা মেলে ধরলাম। ঘরে-বাইরে সমান অন্ধকার, গল্প বই পড়বারও উপায় ছিল না। কারণ দিনের বেলা তো আর মোমবাতি জ্বালানো যায় না। তাই বাইরের অনবরত বৃষ্টি মনের মধ্যে একটা অস্থির ভাব সৃষ্টি করছিল। সেদিন মাঠ থেকে কাটা ধান খামারে নিয়ে আসার পরিকল্পনা ছিল। সেজন্য অনেক শ্রমিকের আসার কথা ছিল। এইসব ভেবে বাবার মাথায় হাত। কাটা ধানগুলি ভেসে গেল বুঝি। বৃষ্টি তখনো চলছে, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া এবং ইন্দ্রদেবতার গর্জন। এত ক্লান্তিকর একঘেয়েমির মধ্যেও মনে পড়ে গেল, বিদ্যাপতির মাথুরের পদ-


কুলিশ শত শত           পাত মোদিত
ময়ূর নাচত মাতিয়া

মত্ত দাদুরী         ডাকে ডাহুকী 

ফাটি যাওত ছাতিয়া।।

দুর্যোগের বর্ণনা

রাধার বুক ফেটে যাচ্ছিল এমন বরষায় কৃষ্ণের অদর্শনজনিত দুঃখে, আমার বুক দুরুদুরু করছিল বাবা ও মার ফসল হারানোর চিন্তা দেখে। অনেক বর্ষাকালের বর্ষা দেখেছি, কিন্তু শীতকালে দিনের বেলায় এত ঝমঝম বৃষ্টি কখনো দেখিনি। সমস্ত আকাশ জুড়ে যেন একটা দক্ষযজ্ঞের আয়োজন। এরই মধ্যে গগনবিদারী বজ্রপাতের শব্দ। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ের বেগ ক্রমশ বাড়তে লাগল। মনে হল পৃথিবীর প্রলয় উপস্থিত-অল্পক্ষণের মধ্যে বোধহয় সব একাকার হয়ে যাবে। গোয়াল ঘর থেকে গরুগুলিও হাম্বা রব করতে থাকল। কারণ তারা আজ সকালে বেরোতে পায়নি, মাঠে ধান ভেসে যাওয়ার চিন্তায় তাদেরকে খাওয়ারও কেউ দেয়নি মনে হয়। এমন সময় হঠাৎ একটা বিকট শব্দে আমাদের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড বটগাছটি পড়ে গেল গোয়াল ঘরের উপর। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল টালির চাল। দুটি গরু চাপা পড়ে গেল। বাড়ির সবাই তখন ব্যস্ত গরুগুলিকে বাঁচাবার জন্য। বৃষ্টির কিন্তু বিরাম নেই, অবিরাম ঝরে চলেছে। দূর থেকে যতদূর দেখা যায় মাঠের কাটা ধান ভাসছে, যে সব ধান কাটা হয়নি, তাও জলের তলায়। পুকুর, মাঠ, ঘাট সব একাকার, যেন মহাসমুদ্র। রাস্তায় গাছ পড়ে গিয়ে লোক চলাচলের পথ বন্ধ। পথে বেরোনোরও প্রয়োজন নেই। কারণ বেরিয়েই-বা কি করবে। দোকান-পাট বন্ধ, কাজের কাজ কিছুই নেই, শুধু বাড়িতে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলা আর প্রকৃতির তাণ্ডব অসহায়ভাবে দেখে যাওয়া। এদিকে বাবা ও কাকা গরু দুটিকে উদ্ধার করে বাড়ির দালানে সেবা-শুশ্রুষায় রত। এত বৃষ্টি ও বজ্রের তাণ্ডবে আমার ছোটভাই মাকে জড়িয়ে কাঁদছে। সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছে। ভয় আমারও যে হয়নি, তা নয়। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল। তখন বৃষ্টির দাপট কিছুটা কমেছে, অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে। পাশের বাড়ির দাদা এলেন বাবার সঙ্গে ধান ভেসে যাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করতে। সেদিন আর রান্নাবান্না হল না। মা আমাদের দুই ভাইকে দুধ আর মুড়ি খাইয়ে দিলেন ও শুয়ে পড়তে বললেন। তাই খেয়ে শুতে গেলাম। কিন্তু সারাদিনের এই দুর্যোগ আমার ঘুম তখন কেড়ে নিয়েছে। আমিও বাবার ফসল হারানোর চিন্তায় সমব্যথী হলাম।

উপসংহার

আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। কতটুকুই বোধ হয়েছে আমার মধ্যে। কিন্তু সেদিনের এই বর্ষণমুখর দিন শুধু অন্য পাঁচটা বর্ষার দিনের মতো ছিল না। কারণ সারা বছরের ধান সামান্য একদিনের বর্ষায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এও ভেবেছিলাম, বৃষ্টিটা যদি আর একদিন পরে হত, তাহলে তো এই ফসল আমাদের হারাতে হত না। কে-ই বা ভেবেছিল, শীতকালে এমন অকাল বর্ষণ হবে। তাহলে তো দুদিন আগেই পাকা ধান খামারে তুলে নেওয়া যেত। শুধু আমার কেন বেশিরভাগ মানুষের এই ক্ষতি স্বজন-হারানোর মতো। তাদের সকলের সঙ্গে আমার মনও সেদিন ডুকরে কেঁদে উঠে বলেছিল-ভগবান, এত ক্ষতি তুমি আমাদের না করলেই পারতে। নিম্নচাপটা তো যেখানে চাষবাস হয় না সেখানে আছড়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে পারতে। তার উত্তর আমি এখনো খুঁজি। আর খুঁজি বলেই সেদিনের সেই বর্ষার দিন আমাকে ব্যাকুল করে। সেদিনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা আমাকে এখনও আমাকে আকর্ষণ করে।

Leave a Comment