একাদশ শ্রেণি দর্শন ভারতীয় নীতিবিদ্যা শ্রীমদ্ভগবতগীতা নিষ্কাম কর্মের ধারণা ছোটো প্রশ্ন ও উত্তর (২য় সেমেস্টার)

একাদশ শ্রেণি দর্শন ভারতীয় নীতিবিদ্যা শ্রীমদ্ভগবতগীতা নিষ্কাম কর্মের ধারণা ছোটো প্রশ্ন ও উত্তর (২য় সেমেস্টার)
একাদশ শ্রেণি দর্শন ভারতীয় নীতিবিদ্যা শ্রীমদ্ভগবতগীতা নিষ্কাম কর্মের ধারণা ছোটো প্রশ্ন ও উত্তর (২য় সেমেস্টার)

Table of Contents

ভারতীয় নীতিতত্ত্বে কর্ম কয়প্রকার ও কী কী?

▶ ভারতীয় নীতিতত্ত্বে কর্ম হল দু-প্রকার-সকাম কর্ম এবং নিষ্কাম কর্ম। কামনা-বাসনা জড়িত কর্মকে বলা হয় সকাম কর্ম-যা বন্ধনের হেতু হয়। আর কামনা-বাসনা বর্জিত কর্মকে বলা হয় নিষ্কাম কর্ম-যা মোক্ষের হেতু হয়।

সকাম কর্ম কাকে বলে?

► যে-কর্মের পিছনে কর্মকর্তার কামনা-বাসনা উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে, তাকেই বলা হয় সকাম কর্ম। এরূপ কর্মের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে কর্মফল এবং সেই কর্মফল কর্মকর্তাকে ভোগ করতেই হয়। সকাম কর্মের জন্যই মানুষ সংসারবন্ধনে আবদ্ধ হয়।

নিষ্কাম কর্ম কী?

► যে-কর্মের পিছনে কর্মকর্তার কোনো কামনা-বাসনা উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে না এবং যেখানে শুধু কর্মের জন্যই কর্ম করা হয়-তাকেই বলা হয় নিষ্কাম কর্ম। নিঃ + কাম = নিষ্কাম। অর্থাৎ, কামনা-বাসনাশূন্য ফলাকাঙ্ক্ষারহিত কর্মই হল নিষ্কাম কর্ম। গীতায় আসক্তিশূন্য কর্মকেই নিষ্কাম কর্ম বলা হয়েছে।

নিষ্কাম কর্মের লক্ষণগুলি কী?

▶ গীতায় নিষ্কাম কর্মের চারটি লক্ষণের উল্লেখ করা হয়েছে। এই চারটি লক্ষণ হল: (i) শুধু কর্মেই ব্যক্তির অধিকারস্থাপন, (ii) ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন, (iii) কর্মে কর্তৃত্বাভিমান বর্জন এবং (iv) সমস্ত কর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ। এই চারটি লক্ষণে সমৃদ্ধ কর্মকে নিষ্কাম কর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়।

নিষ্কাম কর্মের প্রকৃত কর্তা কে?

▶ নিষ্কাম কর্মের প্রকৃত কর্তা হলেন ঈশ্বর। কর্মকর্তারূপী ব্যক্তি-মানুষ কখনোই নিষ্কাম কর্মের প্রকৃত কর্তা নন। একমাত্র ঈশ্বর হলেন আমাদের সমস্ত প্রকার কর্মের পরিকল্পনাকারী এবং তাঁর পরিচালনায় আমরা নিষ্কামভাবে কর্ম করে থাকি। সুতরাং, ঈশ্বরকেই নিষ্কাম কর্মের কর্তা বলা হয়।

নিষ্কাম কর্ম কি কর্মহীনতাকে সূচিত করে?

▶ নিষ্কাম কর্ম কখনোই কর্মহীনতাকে নির্দেশ করে না। বরং বলা যায় যে, নিষ্কাম কর্ম ফলাকাঙ্ক্ষাকে বর্জন করে নিরন্তর কর্ম করার উপদেশ দেয়। কর্মহীনতা কখনোই সকাম বা নিষ্কাম হতে পারে না, একমাত্র কর্মই সকাম বা নিষ্কামরূপে গণ্য হয়। নিষ্কাম কর্ম তাই কর্মহীনতাকে সূচিত না করে, কর্মপ্রবণতাকেই সূচিত করে।

মোক্ষের সহায়ক কোন্ কর্ম?

▶ গীতায় মোক্ষের সহায়করূপে নিষ্কাম কর্মকেই উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, একমাত্র নিষ্কাম কর্মই মানুষকে ক্রমান্বয়ে আধ্যাত্মিক উত্তরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং মুক্তির পথ প্রশস্ত করে। অপরদিকে, সকাম কর্মকে বলা হয় মোক্ষের প্রতিবন্ধক।

মোক্ষমার্গ কী?

▶ ‘মার্গ’ শব্দটির অর্থ হল পথ বা উপায়। অর্থাৎ, যে পথে এগিয়ে গেলে মোক্ষ বা মুক্তিলাভ হয়, তাকেই বলা হয় মোক্ষমার্গ। গীতায় মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে তিনটি মার্গের উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই তিনটি মার্গ বা পথ হল: কর্মমার্গ (কর্মের পথ), জ্ঞানমার্গ (জ্ঞানের পথ) এবং ভক্তিমার্গ (ভক্তির পথ)।

গীতোক্ত মোক্ষমার্গগুলি কি পারস্পরিকভাবে বিরোধী?

▶ গীতোক্ত মোক্ষমার্গগুলি পৃথক পৃথক মার্গরূপে গণ্য হলেও, সেগুলি কিন্তু কখনোই পারস্পরিকভাবে বিরোধী নয়। বরং বলা যায় যে, গীতোক্ত কর্মমার্গ, জ্ঞানমার্গ এবং ভক্তিমার্গ-প্রভৃতি একে অপরের পরিপূরক। কারণ, এই সমস্ত মার্গের সম্মিলিতরূপেই মোক্ষ বা মুক্তিলাভ সম্ভব।

যজ্ঞার্থ কর্ম কী?

▶ ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন করে ঈশ্বরে সমর্পিত চিত্তে কর্ম করার দক্ষতাকেই গীতায় যোগরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এরূপে যোগের পরিপ্রেক্ষিতে যে কর্মসম্পাদন করা হয় সেগুলিকেই বলা হয় যজ্ঞার্থ কর্ম। অর্থাৎ বলা যায় যে, যোগের নিমিত্ত কর্মই হল যজ্ঞার্থ কর্ম।

ভোগার্থ কর্ম কী?

▶ ভোগের নিমিত্ত কর্মকেই বলা হয় ভোগার্থ কর্ম। আমরা আমাদের কামনা- বাসনা চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্নরকম কর্ম করে থাকি এবং এগুলিই ভোগার্থ কর্মরূপে বিবেচিত। এই ধরনের কর্মগুলি তাই আমাদের কামনা-বাসনা দ্বারা সিক্ত এবং কর্মফলপ্রসূতরূপে গণ্য।

কাম্যকর্ম কী?

▶ অভিষ্ট কোনো ফললাভের উদ্দেশ্যে শাস্ত্রবিহিত কর্মকেই বলা হয় কাম্যকর্ম। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, স্বর্গলাভের কামনাহেতু যে জ্যোতিষ্টোমযজ্ঞ সম্পাদন করা হয়, তা একটি কাম্যকর্মরূপে বিবেচিত। এরূপ কর্ম মানুষের করায়ত্ত না হলেও, সাধনার দ্বারা তা লভ্য।

স্থিতপ্রজ্ঞ কাকে বলে?

▶ যে ব্যক্তি সর্বদাই ভগবানের চিন্তায় নিজেকে মগ্ন রাখেন, তিনিই হলেন স্থিতপ্রজ্ঞ। স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির কোনো কামনা-বাসনা থাকে না। তিনি সর্বদাই এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করেন এবং চিত্তের ভূমিতে বিরাজ করেন।

স্থিতধী কাকে বলে?

▶ গীতায় উল্লেখ করা হয়েছে, যে ব্যক্তি আত্মনিষ্ঠ অর্থাৎ, দুঃখেতে বিচলিত নন, আবার সুখেতেও আসক্ত নন, ভয় এবং ক্রোধ-এই উভয় রিপু থেকেই যিনি মুক্ত-সেরূপ ব্যক্তিকেই বলা হয় স্থিতধী ব্যক্তি। স্থিতধী ব্যক্তির পক্ষেই নিষ্কামভাবে কর্ম করা সম্ভব। এঁদের চিত্ত সর্বদা ভগবানেই সমর্পিত।

নিষ্কাম কর্মী কাকে বলে?

▶ কর্মের কৌশল জেনে যিনি কর্ম করেন তাকেই গীতায় নিষ্কাম কর্মীরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলের প্রতি আকাঙ্ক্ষাহীনতা এবং ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে তার সমস্ত কিছুর সমর্পণই হল যোগ। এখানে যোগ শব্দটি সমত্ব অর্থেই ব্যবহৃত। সমত্ববোধ থাকলেই ফলের প্রতি অনাকাঙ্ক্ষা জন্মায় এবং দ্বন্দ্বে যোগীর সমদর্শন হয়।

স্থিতপ্রজ্ঞ কয়প্রকার ও কী কী?

▶ আচার্য শংকর তাঁর গীতাভাষ্যে অবস্থাভেদে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির স্বরূপ দু- ভাবে বর্ণনা করেছেন-সমাধিস্থ স্থিতপ্রজ্ঞ এবং ব্যুত্থিত স্থিতপ্রজ্ঞ। যে, নিষ্কাম যোগী অজ্ঞানের সঙ্গে কামাদি সমস্ত প্রকার বৃত্তিকে পরিত্যাগ করতে সমর্থ-তাঁকেই বলা হয় সমাধিস্থ স্থিতপ্রজ্ঞ। অপরদিকে, স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি যখন সমাধি থেকে ফিরে আসেন, তখন তাঁকেই বলা হয় ব্যুত্থিত স্থিতপ্রজ্ঞ।

স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি কোথায় অবস্থান করেন?

▶ স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি চিত্তের ভূমিতে অবস্থান করেন। ব্যুত্থিত স্থিতপ্রজ্ঞ চিত্তের ভূমিতে থাকেন বলেই ব্যুত্থানের পর ইন্দ্রিয় সন্নিকর্ষ হলেও তিনি নির্লিপ্ত থাকেন। সেকারণেই বলা যায় যে, ব্যুত্থিত স্থিতপ্রজ্ঞের কোনো প্রকার তাপ- অনুতাপ থাকে না, দুঃখে তার মন যেমন উদ্বিগ্ন হয় না, তেমনই সুখেতেও তার কোনো স্পৃহা থাকে না।

নিষ্কাম নীতিতত্ত্বে ও কান্টের নীতিতত্ত্বের পার্থক্য কী?

▶ গীতোক্ত নীতিতত্ত্ব তথা নিষ্কাম নীতিতত্ত্বের সঙ্গে কান্টের নীতিতত্ত্বের তথা “কর্তব্যের জন্য কর্তব্য”-এর একপ্রকার পার্থক্য আছে। আপাতদৃষ্টে দুটি নীতিতত্ত্ব একইরকম বলে মনে হলেও, দুটি কিন্তু এক নয়। কারণ, কান্টের নীতিতত্ত্বের ক্ষেত্রে একপ্রকার স্বার্থবোধের বিষয়টি ক্রিয়াশীল হলেও, গীতার নিষ্কাম নীতিতত্ত্বে স্বার্থশূন্য আসক্তিহীনতার বিষয়টিই প্রতিফলিত হয়েছে।

ব্যুত্থিত স্থিতপ্রজ্ঞের আচার-ব্যবহার কীরূপ?

▶ ব্যুত্থিত স্থিতপ্রজ্ঞের আচার-ব্যবহারকে গীতায় কচ্ছপের আচার-ব্যবহারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কচ্ছপ যেমন পরিস্থিতি অনুযায়ী তার বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেয়, ব্যুত্থিত স্থিতপ্রজ্ঞও তেমনই তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযমপূর্বক নিজের মধ্যে অন্তরীণ করে রাখে। ব্যুত্থিত স্থিতপ্রজ্ঞের প্রজ্ঞা পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়াদির স্বাভাবিক প্রত্যাহারই হল স্থিতপ্রজ্ঞের প্রকৃত আচার-ব্যবহার।

ব্রাহ্মীস্থিতি কী?

▶ গীতায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিষ্কাম স্থিতিপ্রজ্ঞ ব্যক্তির কোনো বিষয়াসক্তি থাকে না। তাঁর চিত্তে যা থাকে তা হল ভগবদাসক্তি। স্থিতধী ব্যক্তির তাই কোনো প্রকার বিষয়ভোগ হয় না। কারণ, তাঁর বিষয়ভোগের কোনো চেতনা থাকে না, চেতনা থাকে ভগবানের প্রতি। স্বাভাবিকভাবে তাঁর কর্তৃত্বাভিমানও থাকে না, এর ফলে যোগী এক পরম স্থিতিলাভ করেন এবং একেই বলা হয় ব্রাহ্মীস্থিতি।

ব্যুত্থিত স্থিতপ্রজ্ঞা কী?

▶ স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি যখন সমাধি অবস্থা থেকে ফিরে আসেন, তখন তাকে বলা হয় ব্যুত্থিত স্থিতপ্রজ্ঞা। এরূপ স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি সমাধিস্থ স্থিতপ্রজ্ঞের ন্যায় চিত্তের ভূমিতে অবস্থান করেন। ব্যুত্থানের পর কাম্য বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়সংযোগ হলেও, তিনি নির্লিপ্ত থাকেন। এরূপ স্থিতপ্রজ্ঞ অনুরাগ, ভয় ও ক্রোধহীনরূপে গণ্য।

সমাধিস্থ স্থিতপ্রজ্ঞা কী?

▶ যে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি সমাধি অবস্থায় থাকেন, তখন তাঁকেই বলা হয় সমাধিস্থ স্থিতপ্রজ্ঞা। এরূপ স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি চিত্তের ভূমিতে অবস্থান করেন। এরূপ ব্যক্তি তত্ত্বজ্ঞানীরূপে গণ্য হন এবং সমস্ত প্রকার দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন।

গীতার কর্মযোগের আদর্শ কী?

▶ গীতার কর্মযোগের আদর্শ হল নিষ্কাম কর্ম। আসক্তিশূন্য কর্মকেই গীতায় নিষ্কাম কর্মরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। সমস্তরকম মোহ থেকে মুক্ত হয়ে কর্ম করাকে বলা হয় আসক্তিশূন্য কর্ম, যা নিষ্কাম কর্মেরই নামান্তর মাত্র। এরূপ বিষয়টিই হল গীতার কর্মযোগের মৌল আদর্শ।

গীতার মতে কর্মযোগ কী?

▶ গীতার মতে, ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য সমত্ববুদ্ধিযুক্ত স্বধর্ম পালনই হল কর্মযোগ। কর্মযোগে তাই কর্মফলের কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকে না, দ্বন্দ্বমূলক বিষয়ের সমত্ব জ্ঞান থাকে এবং এভাবেই স্বধর্ম পালনের জন্য কর্ম করাই হল কর্মযোগ। এরূপ কর্মযোগই মানুষকে পরমসত্তার দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং মানুষ একপ্রকার অনাবিল আনন্দ উপভোগ করে।

ধর্মযুদ্ধ কী?

▶ ধর্মযুদ্ধের অর্থ হল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ, অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের যুদ্ধ। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যে যুদ্ধ, তা হল ধর্মযুদ্ধ। ধর্মযুদ্ধে সার্বিক মঙ্গলসাধন করা হয়। এই ধর্মযুদ্ধ হল ক্ষত্রিয়ের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য। ক্ষত্রিয়ের ধর্মোচিত যুদ্ধ বলে একে ধর্মযুদ্ধ বলা হয়।

Leave a Comment