![]() |
কন্যাভ্রূণ হত্যা: সামাজিক অপরাধ রচনা |
ভূমিকা
আধুনিকতা যদি প্রগতি না হয়ে পরাগতি হয়, তা যদি উন্নত মানসিকতার পরিচায়ক না হয়ে কুসংস্কারযুক্ত হয় তাহলে কৌলীন্য প্রথা, সতীদাহ প্রথা, বহুবিবাহ প্রথা, পণপ্রথা এবং কন্যাভ্রূণ হত্যার মতো অপরাধ ঘটতেই থাকে। বর্তমানে এই কৃত্রিম বস্তুবাদী সভ্যতায় যেখানে মানবিক সম্পর্ক অবলুপ্তির পথে, যেখানে মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ববোধ-এ ভাটার টান সেখানে যে কোনো অমানবিক কাজ যে সম্ভব, সে বিষয়ে বলার অপেক্ষা থাকে না। কিন্তু শিথিল মানবিক সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস যদি সম্ভব হয়, যদি সম্ভব হয় মানবিক চিত্তবৃত্তিগুলিকে সজীব ও সজাগ রাখা, তাহলে কন্যাভ্রুণ হত্যার মতো
কন্যাভ্রুণ হত্যা কী
কলঙ্কজনক অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটতে পারে। মায়ের গর্ভে থাকার সময় সন্তান যে অবস্থায় থাকে, গর্ভজাত সেই সুপ্ত অঙ্কুরকে ভ্রুণ বলে। আর গর্ভের ভ্রূণ যখন ভ্রূণ অবস্থাতেই হত্যা করা হয় তখন তাকে ভ্রূণ হত্যা বলে। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা আজ যেহেতু সহজ ঘটনা, তাই কন্যাভ্রূণ হত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে। সর্বশেষ (২০১১) সেন্সাস রিপোর্টেও কন্যাভ্রূণ হত্যা বালক-বালিকার জন্মের অনুপাতের হিসেবে প্রমাণিত হল।
কারণ
কন্যাভ্রূণ হত্যার প্রথম কারণ হল আমরা নামে মাত্র আধুনিক হয়েছি। কিন্তু আমরা আমাদের শিরায়-উপশিরায় বহন করছি মধ্যযুগীয় অমানবিক চেতনাকে কিম্বা প্রাচীন অরণ্য সভ্যতার আদিম বর্বর বৃত্তিগুলিকে। প্রাচীন ভারতের প্রতি যদি আমরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে দেখতে পাব, সমাজে নারীর স্থান ছিল নিম্নে। নারীকে পুরুষের তুলনায় ছোটো করে দেখানোর জন্যই এই লিঙ্গ বৈষম্য। তাছাড়া প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থায় যেহেতু অর্থনৈতিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরাসরি পুরুষেরা যুক্ত থাকতো, তাই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব তৈরি হয়েছে। কেন-ই বা হবে না। মহাভারতে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণ রেখেছিলেন এবং কৌরব সভায় সকলেই বিনা দ্বিধায় তা মেনে নিয়েছিলেন। সেই মহাভারতের সময় থেকে নারী-দানের সামগ্রী (সভাপর্ব)। এমনকি হিন্দু বিবাহে এখনও কন্যা সম্প্রদান করা হয়, অর্থাৎ হস্তান্তরের সামগ্রী। তাছাড়া মহাভারতের ‘আদি পর্বে পাতিব্রত্যের আদর্শ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘পুরুষদিগের বহুবিবাহ দোষাবহ নহে, কিন্তু নারীদিগের পত্যন্তর স্বীকারে মহা অধর্ম জন্মে।’ সুতরাং এইসব ঘটনার সরণি ধরেই আধুনিক মানুষের মধ্যে লিঙ্গবৈষম্য প্রভাব বিস্তার করেছে বলেই এই কন্যাভ্রূণ হত্যা ঘটে চলেছে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে অভিভাবকদের মধ্যে নারী সম্বন্ধে একটা হীনমন্যতাবোধ কাজ করে আসছে। একটি বাড়িতে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে থাকলে, মা ছেলেকে যেভাবে যত্ন করেন ঠিক সেভাবে মেয়েটিকে যত্ন করেন না; ছেলে দুষ্টুমি করলে যে শাসন করেন, মেয়ের ক্ষেত্রে তা হয় অনেক বেশি। এসব করেন এই ভেবে যে মেয়েটিকে পরের ঘরে দিতে হবে, তাই তাকে সেভাবে গড়ে তোলা উচিত। তাই মেয়ে সংসারে কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে না।
তৃতীয়ত, আজকাল মা-বাবা ভাবেন, ছেলে হলে তাদের কাছে থাকবে, অপর বাড়ি থেকে মেয়ে আনবে, তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার তাদের বংশে বা ঘরেই থাকবে। অন্যদিকে মেয়ে হলে সে শুধু অপরের হবে না, তাদের সম্পত্তিও অপরের হয়ে যাবে। তাছাড়া, বৃদ্ধ অবস্থায় ছেলে-বৌ তাদের সেবা-শুশ্রুষা করবে, মেয়ে-জামাই তো এসে তা করবে না। এই ভাবনা কন্যা সন্তানকে তাই অবাঞ্ছিত মনে করে। তাছাড়া সাধারণ মানুষ মনে করে পুত্রসন্তান হলে সে আয় করে বাবা-মাকে খাওয়াবে, মেয়ে তো তা করতে পারে না-কেননা তার বিয়ে হয়ে যাবে।
চতুর্থত, একজন নারী আর একজন নারীর আগমনকে বাঞ্ছিত মনে করেন না। একজন নারী অন্য নারীর (শাশুড়ী-বধূ, ননদ-বধূ) উপর বৈষম্যমূলক আচরণ করেন। একজন নারীবাদী কিম্বা একজন নারীবাদী পুরুষও মনে-প্রাণে নারীকে যতটা জায়গা করে দিতে চান, তার থেকে নিজেকে বা নিজের সুবিধাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বেশি সচেষ্ট হন। তাই এই ধরনের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে।
সমাধান
এজন্য চাই নারীদের আগে এগিয়ে আসা এবং পুরুষদের তাদের সহযোগিতা করা। কারণ নারী ও পুরুষের সমন্বিত চেষ্টায় সমাজ এগিয়ে চলে। নারী-পুরুষের প্রতিযোগিতার মনোভাব ত্যাগ করে, ছেলেবেলা না মেয়েবেলা, মহিলা সমিতি না পহিলা সমিতি- এসব তর্ক-বিতর্কে প্রবেশ না করে উপলব্ধি করতে হবে, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান শ্রেষ্ঠ চিরকল্যাণকর/অর্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ বিশেষ করে আজকের অভিভাবকদের ভাবতে হবে পুত্র হোক্ কিম্বা কন্যা হোক্-তাকে যথাযথভাবে মানুষ করে তুলতে পারলে, মানবিক গুণের আধার হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে-কেউ পিছিয়ে থাকবে না। দরকার, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। কেননা বৌ-ছেলে হলেই বাবা-মাকে খেতে দেবে, মেয়ে-জামাই দেবে না-এটা কোনো কথার কথাই নয়।