![]() |
চার্বাক জড়বাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। |
জড়বাদ হল এমনই এক দার্শনিক মতবাদ, যে মতবাদ অনুযায়ী দাবি করা হয় যে জড়ই (Matter) হল জগতের পরম তত্ত্ব। জড়বাদে তাই জগতের সব কিছুকেই জড়াত্মক বলে উল্লেখ করা হয়। জড়বাদে আরও দাবি করা হয় যে, জীবজগৎ জড় পদার্থেরই অভিব্যক্তি বা রূপান্তর মাত্র। এরূপ মতবাদ তাই সম্পূর্ণরূপে অধ্যাত্মবাদের এক বিরোধী মতবাদরূপে গণ্য। ভারতীয় দর্শনে জড়বাদের প্রচার করেছে একমাত্র চার্বাক সম্প্রদায়।
চার্বাক জড়বাদের প্রাচীনত্ব
ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যে চার্বাক সম্প্রদায় হল সর্বাপেক্ষা প্রাচীন আর এই সম্প্রদায়ই জড়বাদের প্রবর্তক। সুতরাং এই দাবি করা সংগত যে, জড়বাদ হল এক অত্যন্ত প্রাচীন মতবাদ।
প্রত্যক্ষ প্রমাণবাদে বিশ্বাস
চার্বাকগণ হলেন প্রত্যক্ষ প্রমাণবাদী। এই প্রত্যক্ষ প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই তাঁরা জড়বাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁরা কোনো অতীন্দ্রিয় ও অলৌকিক তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। সে কারণেই তাঁরা অধ্যাত্মবাদের যুক্তি খণ্ডন করেছেন এবং জড়বাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন।
জড়বাদ, স্বভাববাদ ও যদৃচ্ছাবাদে আস্থা
চার্বাক মতে, ক্ষিতি, অপ্, তেজ এবং মরুৎ-এই চারটি ভূতের সংমিশ্রণে জগৎ গঠিত। এই চারটি মহাভূত প্রত্যক্ষযোগ্য বলে এদের অস্তিত্ব চার্বাকগণ স্বীকার করেন। এই চারটি মহাভূত ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ে আকাশকে (ব্যোম) পঞ্চম মহাভূত বলে স্বীকার করা হয়। কিন্তু তা প্রত্যক্ষযোগ্য নয় বলে, চার্বাকগণ আকাশ তথা ব্যোমকে স্বীকার করেন না। এই চারটি ভূত নিজ নিজ স্বভাব অনুসারে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে জগৎ সৃষ্টি করেছে। তাদের এই মিলন কিন্তু আকস্মিক। এগুলির মিলনের পিছনে কোনো পরিকল্পনা নেই। এখানে ঈশ্বরেরও কোনো ভূমিকা নেই। সে কারণেই চার্বাক জড়বাদকে স্বভাববাদ বা যদৃচ্ছাবাদরূপে উল্লেখ করা হয়।
দেহাত্মবাদে বিশ্বাস
চার্বাক মতে, চতুর্ভূতের সংমিশ্রণের ফলে জড়াত্মক দেহের উদ্ভব হয় এবং সেখানে চৈতন্য নামে এক আকস্মিক গুণের আবির্ভাব হয়। এই চৈতন্যই হল আত্মা। এ ছাড়া আত্মার আর অন্য কোনো পরিচয় নেই। নিত্য ও চিরন্তন আত্মার অস্তিত্ব তাই নিরর্থক মাত্র। সে কারণেই জড়বাদের পরিপ্রেক্ষিতে চার্বাকদের আত্মা-সম্পর্কিত মতবাদটি দেহাত্মবাদ নামে খ্যাত।
অতীন্দ্রিয় সত্তায় অবিশ্বাস
চার্বাকগণ যেহেতু জড়বাদের সমর্থক, সেহেতু তাঁরা অতীন্দ্রিয় ঐশ্বরিক সত্তায় বিশ্বাসী নন। তাঁদের কাছে জগৎ সৃষ্টির কারণরূপে ঈশ্বরের কল্পনা তাই একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। এভাবেই তাঁরা কর্মবাদ, জন্মান্তরবাদ, পাপপুণ্য, স্বর্গ-নরক প্রভৃতিকেও অস্বীকার করেছেন। চার্বাক সম্প্রদায়ের মতে, এই সমস্ত বিষয়গুলি প্রত্যক্ষযোগ্য নয় বলে, এগুলি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সমস্ত বিষয়গুলি জড়বাদের বিরোধীরূপেও গণ্য।
একমাত্র কাম্য হিসেবে ইন্দ্রিয় সুখ
চার্বাক জড়বাদে দৈহিক সুখ তথা কামই হল জীবনের চরম পুরুষার্থ। দৈহিক সুখ তথা কাম চরিতার্থ করার জন্য অর্থের প্রয়োজন। সে কারণেই তাঁরা অর্থকে গৌণ পুরুষার্থরূপে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, মানুষমাত্রেই চতুর্ভূতে সৃষ্ট জীবিত জীবদেহ মাত্র। সুতরাং দৈহিক সুখভোগই হল মানুষের একমাত্র কাম্য বস্তু। তাই তাঁরা বলেন-
“যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।”
অর্থাৎ, যতদিন বাঁচো সুখে বাঁচো। ঋণ করে ঘি খাও।