চিত্রশিল্পের ওপর রেনেসাঁ বা নবজাগরণের প্রভাব লেখো
অথবা, রেনেসাঁ যুগের চিত্রশিল্পের ওপর টীকা লেখো

ভূমিকা
ইউরোপের নবজাগরণের অন্যতম প্রধান অবদান হল তার শিল্পস্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা। চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে রেনেসাঁ ধ্রুপদি যুগকেও অতিক্রম করে বহুদূরে অগ্রসর হয়ে যায়। মানবতাবাদ ও প্রগতিবাদী চেতনা রেনেসাঁ চিত্রশিল্পকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। চিত্রশিল্পে এসেছিল এক নতুন আঙ্গিক। চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই ইটালিতে বিশেষ করে ফ্লোরেন্সে চিত্রশিল্পের ব্যাপক চর্চা শুরু হয়েছিল।
(1) ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত চিত্রকলা: মধ্যযুগীয় কঠোর ধর্মকেন্দ্রিকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে রেনেসাঁ যুগের চিত্রকলার শিল্পীরা তাদের মানবতাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মনন দ্বারা চিত্রকলাকে করে তোলেন আধুনিক। মানবশরীর, তার জীবনচর্চা, প্রকৃতি সবই শিল্পীদের রংতুলির স্পর্শে হয়ে ওঠে জীবন্ত। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ভাষায়-“মানুষের চোখ হল আত্মার জানালা।” এ যুগে চিত্রকরদের চোখ আর আত্মার সম্মিলন চিত্রশিল্পে বিপ্লব ঘটায়।
(2) রেনেসাঁর প্রাথমিক পর্যায়ের চিত্রকলা : ঐতিহাসিক জর্জিও ভাসারি তাঁর Lives of the Artists গ্রন্থে ত্রয়োদশ শতকের চিত্রকর গিয়োট্টো বনডানোকে আধুনিক শিল্পরীতির অগ্রদূত বলেছেন। যদিও সাম্প্রতিক চিত্রকলার ঐতিহাসিকরা গিয়োট্টোকে রেনেসাঁ চিত্রকলার জনক মানতে রাজি নন, কারণ তিনি মধ্যযুগীয় রীতিতেই এঁকেছেন এবং তিনি কোনো Perspective ব্যবহার করেননি; তথাপি গিয়োট্টোর আঁকা মানব প্রতিকৃতিতে যে বাস্তবতার ছাপ ছিল তা নতুন শিল্পরীতির সূচনাই বলা যেতে পারে।
- গিয়োট্টোর উত্তরসূরি ম্যাসাচ্চিত্ত ছবিতে Space বা পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে ছবির মূল বিষয়ের সম্পর্কস্থাপন করে চিত্রশিল্পে ভিন্নমাত্রা আনেন। ছবিতে ত্রিমাত্রিকতার ব্যবহারও শুরু করেন ম্যাসাচ্চিও। শাপভ্রষ্ট হয়ে স্বর্গ থেকে বিদায়ের মুহূর্তে অ্যাডাম ও ইভের যে নগ্ন প্রতিকৃতি ম্যাসাচ্চিত্ত এঁকেছেন, তার প্রতিটি ভঙ্গি ছিল হতাশার অভিব্যক্তি, যন্ত্রণার বাস্তব প্রতিবিম্ব।
- পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফ্লোরেন্সের চিত্রকরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বত্তিচেল্লি। তাঁর ‘বার্থ অফ ভেনাস’ (Birth of Venus)-এ তিনি এক অতিপ্রাকৃত দৃষ্টিনন্দন কল্পনার জগৎ তৈরি করেছেন। ভেনাস-এর চিত্র সে যুগে চার্চের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ স্বরূপ ছিল। এ ছাড়া বার্তালোমেও, ভেরোচ্চি ও পেরুজিনো প্রমুখ রেনেসাঁ যুগের শুরুর দিকের শিল্পী হিসেবে নিজেদের স্বাক্ষর রেখেছেন।
(3) পরিণত রেনেসাঁ যুগের চিত্রকলা: পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে যাকে ‘High Renaissance Art’ বলা হয়; তার প্রধান চরিত্র- লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো ও রাফায়েল টিশিয়ান।
- লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি শবব্যবচ্ছেদ করে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক জ্ঞান অর্জন করে তা চিত্রে প্রয়োগ করেন। ‘মোনালিসা’, ‘দ্য লাস্ট সাপার’, ‘ভার্জিন অফ দ্য রক্স’ তাঁর অমর সৃষ্টি। ভিঞ্চির প্রতিটি ছবি আলো-আঁধারির পরিমিত ব্যবহারে অনন্য হয়ে উঠেছে। দূরের ও কাছের জিনিস আঁকার ক্ষেত্রে তাঁর গাণিতিক বোধের ব্যবহার রেনেসাঁ চিত্রশিল্পের অন্যতম আবিষ্কার।
- মাইকেল এঞ্জেলো ‘সিস্টিন চ্যাপেলে’ (Creation of Adam) নামে যে দেয়াল চিত্র এঁকেছেন তাতে, পৃথিবীর প্রথম মানবের দেহসৌষ্ঠবের মধ্যে তাঁর জীবনী শক্তির চিত্রায়ন ঘটিয়েছেন।
- রাফায়েলের চিত্রশিল্পের প্রধান বিষয় ছিল মাতৃমূর্তি। ভিন্ন ধরনের দীর্ঘদেহ, লম্বাটে মুখমণ্ডল ও সুন্দর নাক, মুখ, চোখের সমাবেশ তাঁর মাতৃমূর্তিকে (‘ম্যাডোনা’ ও ‘সন্ত ক্যাথারিন’) বিশিষ্ট করে তুলেছে।
(4) নতুন অঙ্কন পদ্ধতি: মধ্যযুগীয় টেম্পেরা রঙের পরিবর্তে তিসির তেল বা জলপাই-এর তেল মিশিয়ে তেল-রঙের ব্যবহার শুরু হয়। প্লাস্টার করা দেয়ালের ওপর সরাসরি আঁকার (ফ্রেসকো) বদলে কাঠের ফ্রেমে মোটা কাগজ (easel), ক্যানভাস, কাঠের পাতলা টুকরো ইত্যাদির ওপর ছবি আঁকা শুরু হয়।
মূল্যায়ন
সবশেষে বলা যায়, চিত্রশিল্প রেনেসাঁর এক অবিস্মরণীয় অবদান। এ যুগের শিল্পীরা নিসর্গ চিত্রের ব্যবহার, আলোর ব্যবহার এবং মানবশরীরকে যথাযথভাবে চিত্রায়িত করেছেন। এইভাবে ত্রয়োদশ শতকের শেষ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত ইউরোপে এক নতুন চিত্রশৈলীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর