![]() |
“চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হল আত্মা।” – চার্বাকদের এরূপ অভিমতের সবিচার আলোচনা করো। |
বেশিরভাগ ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় আত্মা সম্পর্কে যে মতবাদ পোষণ করে, চার্বাক সম্প্রদায় কিন্তু তার ঠিক বিপরীত কথা বলে। অন্যান্য ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের মতে, আত্মা হল দেহের অতীত কোনো স্থায়ী সত্তা। এই সত্তা হল অজড়াত্মক ও অতীন্দ্রিয়। আত্মা হল নিত্য ও শাশ্বত এবং এর কোনো বিনাশ নেই। আত্মা শুধুমাত্র এক অবস্থা থেকে আর-এক অবস্থায় রূপান্তরিত হয় মাত্র। কিন্তু চার্বাকগণ আত্মা সম্পর্কে এধরনের অভিমত গ্রহণ করেন না।
চৈতন্যবিশিষ্ট দেহ হিসেবে আত্মা
চার্বাকগণ দেহের অতিরিক্ত স্বতন্ত্র নিত্য আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে, “চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হল আত্মা”। সেজন্যই আত্মা-সম্পর্কিত চার্বাকদের মতবাদকে বলা হয় দেহাত্মবাদ। চার্বাকগণ চিরন্তন আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করলেও, চৈতন্যকে অস্বীকার করেননি। তাঁরা দাবি করেন যে, চৈতন্যকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। এই চৈতন্য হল দেহেরই একটি গুণ। মানবদেহ ছাড়া আর অন্য কোনো জড়বস্তুতে চৈতন্য থাকে না। এই চৈতন্যযুক্ত দেহই হল আত্মা। এ ছাড়া আত্মার আর দ্বিতীয় কোনো পরিচয় নেই।
ভূতচৈতন্যবাদ
চার্বাক মতে, ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং মরুৎ-এই চতুর্ভুতের এক বিশেষ সংমিশ্রণে জীবদেহ গঠিত হয়। এই চতুর্ভূতের স্বভাব অনুযায়ীই জীবদেহে চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটে। জড় চতুর্ভূতে চৈতন্যের অস্তিত্ব না থাকলেও, তাদের বিশেষ সংমিশ্রণে গঠিত দেহে চৈতন্যের আকস্মিক আবির্ভাব হয়। যেমন-পান, চুন, সুপারি ও খয়ের-এই চারটি উপাদানের মধ্যে লাল রং না থাকলেও সেগুলি একসঙ্গে চিবোনো হলে, তাতে লাল রঙের সৃষ্টি হয়। সুতরাং চৈতন্য হল দেহের একটি আকস্মিক গুণ। দেহের ধ্বংস হলে আর এই চৈতন্যও থাকে না।
দেহের বিনাশের সঙ্গেই চৈতন্যের বিনাশ
চার্বাক মতে, চৈতন্য মানেই হল দেহে আশ্রিত চৈতন্য। সে কারণেই দাবি করা সংগত যে, চৈতন্য দেহেরই গুণ এবং চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হল আত্মা। এর বাইরে আত্মার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। আমরা অনেক সময় বলে থাকি যে, ‘আমি মোটা’, ‘আমি রোগা’, ‘এটা আমার দেহ’ইত্যাদি। এসব থেকে প্রমাণিত হয় যে, ‘দেহ’ এবং ‘আমি’ বা ‘আত্মা’ এক ও অভিন্ন। দেহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্যেরও অবলুপ্তি ঘটে। মৃত্যুই জীবের জীবনের শেষ কথা। সুতরাং জন্মান্তর ও আত্মার নিত্য সত্তা নিরর্থক ও অসার কল্পনামাত্র।
সমালোচনা
চার্বাক দেহাত্মবাদ সূক্ষ যুক্তিতর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও, তা কখনোই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। চার্বাক মতানুযায়ী দাবি করা হয়েছে যে, চৈতন্য হল দেহের একটি গুণ এবং এই চৈতন্যই হল আত্মা। কিন্তু উল্লেখ করা যায় যে, দেহের অন্যান্য বিশেষণগুলির ন্যায় চৈতন্য কখনোই দেহের একটি গুণ রূপে গণ্য হতে পারে না। কারণ দেহের অপরাপর গুণগুলি যেমন-মূর্ছা, সুষুপ্তি এবং এমনকি প্রাণহীন দেহ বজায় থাকলেও, সেভাবে চৈতন্য থাকে না। সুতরাং চৈতন্যকে দেহের গুণ বলা অযৌক্তিক। আরও উল্লেখ করা যায় যে, চৈতন্য দেহের গুণরূপে গণ্য হলে, স্মৃতি ও প্রত্যভিজ্ঞার বিষয়গুলির ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। সুতরাং আত্মা-সম্পর্কিত চার্বাকদের মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়।