ছাপাখানার বাণিজিক উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো

ছাপাখানার বাণিজিক উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো
ছাপাখানার বাণিজিক উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো

উনিশ শতকে ছাপাখানা স্থাপন বাঙালির কাছে বিশেষ গৌরব ও নেশার বিষয় হয়ে উঠেছিল। এ নেশা এমনই ছিল যে, এজন্য অনেকে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করতেও কসুর করেননি। এ সময় ছাপাখানা মালিকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন গুণী, পণ্ডিত, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক এবং ধনাঢ্য ব্যক্তি। এঁদের এক এক জনের উদ্দেশ্য ছিল এক এক রকম। কারও উদ্দেশ্য সংবাদপত্র প্রকাশ, কেউ চান নিজের লেখা বইপত্র ছাপতে, আবার অনেকের উদ্দেশ্য নিছক ব্যবসা করা। গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, বিশ্বনাথ দেব, কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকার থেকে একেবারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, উপেন্দ্রনাথ দাস, গিরিশচন্দ্র বসু, শিশিরকুমার ঘোষ, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ব, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, প্যারীচরণ সরকার, কাঙাল হরিদাস প্রমুখ বহু নাম করা যায়। 

  • পঞ্চানন্দ কর্মকারের জামাতা মনোহর কর্মকার ও পুত্ররা একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এর নাম ‘চন্দ্রোদয় যন্ত্র’। এর যথেষ্ট সুনাম ছিল। 
  • দুর্গাচরণ গুপ্ত স্থাপন করেন ‘গুপ্তযন্ত্র’। তাঁর বইয়ের দোকানের নাম ‘গুপ্ত ব্রাদার্স’। গুপ্তযন্ত্রে ছাপা ‘গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা’ আজও বাঙালির সম্পদ। 
  • প্যারীচরণ সরকার মূলত নিজের বই প্রকাশের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘স্কুল বুক প্রেস’। এখান থেকে বেশ কিছু সংবাদপত্রও ছাপা হয়েছে। 
  • ছাপাখানার ব্যবসা করে সেদিন বেশ কিছু বাঙালি প্রচুর অর্থ রোজগার করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন পাতিহালের জমিদার বরদাপ্রসাদ মজুমদার। প্রেসের নাম ছিল ‘বি.পি.এম’। সব ছেড়ে দিয়ে কলকাতার ঝামাপুকুরে এক টুকরো জমি কিনে ছোটো চালাঘরে বসালেন ‘হ্যান্ড মেসিন প্রেস’। তারপর এলেন বইয়ের ব্যবসায়। বর্তমান যুগে ‘দেব সাহিত্য কুটির’ এভাবেই সৃষ্টি হল। 
  • এছাড়া আরও কিছু ছাপাখানা ও মালিকের নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা ব্যবসায়ী হিসেবে সফল ছিলেন। এ ব্যাপারে কমলালয় (দীননাথ দাস), চৈতন্যচন্দ্রোদয় (মধুসুদন শীল), জেনারেল প্রিন্টিং (বেণীমাধব ভট্টাচার্য), ‘ন্যাশনাল’নবগোপাল মিত্রের ‘ন্যাশনাল প্রেস’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও তাঁর বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘সংস্কৃত যন্ত্র’, ঢাকার ‘আদর্শ যন্ত্র’, ‘সুদর্শন যন্ত্র’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ছাপাখানার ইতিহাস শুধু হাসির ইতিহাস নয়- এর সঙ্গে বহু কান্নাও জড়িয়ে আছে। অনেকই এই ব্যবসায় এসেছেন। অনেকে পুরুষানুক্রমে ব্যবসা চালিয়েছেন। অনেকে যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা করেছেন। এদের অধিকাংশই ছিলেন মধ্যবিত্ত এবং পেশায় শিক্ষক। এদের সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না। তাই ছাপার খরচ জোগানোর জন্য তাদের অংশীদারিত্বের পথে যেতে হয়, অথবা ধনীদের দ্বারস্থ হতে হয়। ‘বাঙ্গাল গেজেটি’-র সম্পাদক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য হরচন্দ্র রায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে স্থাপন করেন ‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’। বিদ্যাসাগর ও তাঁর বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের প্রেসও ছিল যৌথ উদ্যোগের উদাহরণ। এ ধরনের অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কাঙ্গাল হরিনাথ ঋণগ্রস্ত হয়ে তাঁর প্রেস বিক্রি করে দেয়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ঋণগ্রস্ত পরিবার তাঁর প্রেস বিক্রি করে দেয়।

বাংলা মুদ্রণ শিল্পের জগতে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫ খ্রিঃ) ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইউ. এন. রায় এন্ড সন্স‘ (১৮৯৫ খ্রি.) এক বিশিষ্ট নাম। একাধারে সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, চিত্রকর, আলোকশিল্পী, প্রকাশক ও মুদ্রক হিসেবে খ্যাতিমান হলেও রঙিন ও হাফটোন ব্লক তৈরি ও গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ও তাঁর পুত্র সুকুমার রায় তাঁদের উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে ‘ইউ. এন. রায় এন্ড সন্স’ নামক সংস্থাটিকে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ছাপাখানায় পরিণত করেন। তিনি ভারতবর্ষে হাফটোন ব্লকের প্রবর্তন করেন এবং গবেষণার মাধ্যমে তার প্রভূত উন্নতি ঘটান। রঙিন মুদ্রণের জন্য তিনি নানাপ্রকার ডায়াফর্ম যন্ত্র, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডুয়োটাইপ ও টিন্ট প্রসেস পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁর নাম যুক্ত করে ‘রে-স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার’ এবং ‘রে-টিন্ট সিস্টেম’ নামকরণ করা হয়। তাঁর পুত্র শিশু- সাহিত্যিক সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৪ খ্রিঃ) ছিলেন পিতার যোগ্যপুত্র। মুদ্রণশিল্প ও প্রযুক্তিতে তাঁরও অবদান ছিল বিরাট।

Leave a Comment