জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিকগুলি মূল্যায়ন করো
অথবা, উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক হিসেবে জন লকের রাষ্ট্রচিন্তা আলোচনা করো

ভূমিকা
সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ড তথা পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হলেন জন লক (১৬৩২-১৭০৪ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁকে উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক বলে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন আধুনিক গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রতত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লবের পটভূমিতে এই ব্রিটিশ চিন্তাবিদ তাঁর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে রাষ্ট্রতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন।
রচিত গ্রন্থ
জন লকের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কিত সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘টু ট্রিটিজেস অফ গভর্নমেন্ট’ (Two Treatises of Government)। এ ছাড়াও অ্যান এসে কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং (An Essay Concerning Human Understanding), সেকেন্ড ট্রিটিজ (Second Treatise) প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে লক তাঁর অভিনব রাষ্ট্রচিন্তা ব্যাখ্যা করেছেন।
জন লকের রাষ্ট্রতত্ত্ব
(1) প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্ব: হক্স যেখানে প্রকৃতির রাজ্য (State of Nature)-কে অসহনীয় ও বিশৃঙ্খলাময় বলে ব্যাখ্যা করেছেন, লক তার সম্পূর্ণ উলটো মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রব্যবস্থার আবির্ভাবের আগে প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন ছিল সহজ, সরল এবং সুখী। তখন সকলেই প্রাকৃতিক আইন (Natural Laws) মেনে চলত। তাই এ সময় সকলেই ছিল স্বাধীন ও সমঅধিকারসম্পন্ন। কিন্তু পরবর্তীকালে সম্পত্তির অধিকারকে কেন্দ্র করে যখন সমাজে অসাম্য ও দ্বন্দু বৃদ্ধি পায়, তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে রাষ্ট্রের।
(2) সামাজিক চুক্তি: লকের মতে, সম্পদ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে জটিলতা বৃদ্ধি পায়। এই সমস্যা নিরসনের উদ্দেশ্যে সামাজিক চুক্তি-র মধ্যে দিয়ে মানুষ একসময় রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। তাঁর মতে, এই চুক্তির মূল কারণ ছিল-(i) একটি সার্বভৌম প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক আইনকে রক্ষা করা। (ii) জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করা ইত্যাদি।
(3) চুক্তি সম্পর্কে ধারণা: লকের মতে, দুটি চুক্তির মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তাঁর মতে, প্রথম চুক্তিটি হয়েছিল প্রাকৃতিক সমাজের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে প্রত্যেকের। আর দ্বিতীয় চুক্তিটি হয়েছিল সকল জনগণের সঙ্গে শাসকের। প্রথম চুক্তিটি ছিল সামাজিক চুক্তি এবং দ্বিতীয়টি ছিল সরকারি চুক্তি। এইভাবে জনগণ দুটি চুক্তির মাধ্যমে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ বা শাসকের হাতে তাদের সকল ক্ষমতা অর্পণ করে।
(4) জনগণের সম্মতি: লক বলেছেন, জনগণ তার অধিকার, জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থেই সকলের সম্মতির ভিত্তিতে শাসককে রাষ্ট্র ক্ষমতা তুলে দেয়। তাই শাসক জনগণের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করলে বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার জনগণের আছে।
(5) সম্পত্তির অধিকার: জন লক সম্পত্তির অধিকারকে মানুষের একটি স্বাভাবিক মৌলিক অধিকার বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, সকল মানুষই সমানভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগের অধিকারী। লক বলেছেন, মানুষের রাষ্ট্র সৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল সম্পত্তি রক্ষা করা। তিনি মনে করতেন, সম্পত্তির অধিকার ছাড়া জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার উপভোগ করা সম্ভব নয়।
(6) ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার: লক ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। লকের মতে, “স্বাধীনতা হল মানুষের একটি জন্মগত মৌলিক অধিকার।” তাই শাসক তথা রাষ্ট্রের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা অনুচিত বলে তিনি মনে করেন। তবে লক মনে করতেন, অবাধ স্বাধীনতা মানুষকে স্বেচ্ছাচারী করে তুলতে পারে।
(7) সার্বভৌমিকতার ধারণা: সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে লক সরাসরি কিছু ব্যক্ত করেননি। জনগণই হল রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস, এ কথা তিনি জোরের সঙ্গে বলেছেন। এর দ্বারা জনগণই যে রাষ্ট্রের প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, তা পরোক্ষে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
(8) সরকার: লকের মতে, সরকার বা শাসনব্যবস্থা রাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক বা অভিজাততান্ত্রিক হতে পারে; তবে সরকার যে ধরনেরই হোক না কেন তাকে নির্দিষ্ট আইন অনুসারে চলতে হবে। আর সরকারের প্রধান কাজ হবে জনকল্যাণ, সঠিক আইন প্রণয়ন ও সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনা করা। তিনি রাষ্ট্রের শাসন, আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বিভাজনের পক্ষপাতী ছিলেন।
(9) উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তা: লক ছিলেন উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তার অগ্রদূত। তিনিই প্রথম শাসক বা সরকারের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার বিরোধিতা করেন। সেইসঙ্গে ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এইভাবে উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিস্থাপন করেন।
সীমাবদ্ধতা
নানা দৃষ্টিকোণ থেকে লকের রাষ্ট্রতত্ত্বের সমালোচনা করা হয়েছে।
- অনেকের মতে, লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদের তেমন বাস্তব ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
- লক প্রকৃতির রাজ্যের নিয়মকানুনগুলি যে ঈশ্বরের বিধান বলে মনে করেছেন, তা বিজ্ঞানসম্মত নয়।
- অধ্যাপক গেটেলের মতে, “লক সম্পত্তির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে আসলে পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্রকেই সমর্থন করেছেন।” তাই ম্যাকফারসন লককে বুর্জোয়া চিন্তাবিদ বলেছেন।
মূল্যায়ন
লকের রাষ্ট্রতত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনিই প্রথম শাসকের দৈব অধিকার তত্ত্বের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রকে একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরেন। প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্ব, সম্পত্তি ও ব্যক্তিস্বাধীনতার তত্ত্ব, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর ধারণা আধুনিক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিস্থাপন করেছিল। অধ্যাপক গেটেলের মতে, “লকের মতো কোনো রাষ্ট্রচিন্তাবিদ মানুষের চিন্তা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর এত গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি।”
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর