জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থানের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো— ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে হিটলার ‘জার্মান ওয়ারকার্স পার্টি’ বা জার্মান শ্রমিক দলে যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি এই দলের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হন। কিছুদিন পর এই দলের নতুন নামকরণ হয় ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়াকার্স পার্টি’ বা নাতসি দল।
তো চলুন আজকের মূল বিষয় জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থানের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো পড়ে নেওয়া যাক।
![]() |
জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থানের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো
|
জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থানের কারণ
হৃতসর্বস্ব জার্মানি-প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জার্মানিকে এক শোচনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এই পরাজয়ের ফলে কেবল জার্মানির আন্তর্জাতিক মর্যাদাই ক্ষুণ্ণ হয় নি, জার্মানির ওপর অপমানজনক শন্তিচুক্তি চাপিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো জার্মানিতেও মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যাভাব, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দুষ্প্রাপ্যতা, বেকারত্ব, শিল্প ধর্মঘট চরম আকার ধারণ করে। সব মিলিয়ে জার্মানিতে এক বিস্ফোরক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এসবের ফলে জার্মানির অভ্যন্তরে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। জার্মানির স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই অবস্থায় জার্মান সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম সপরিবারে হল্যান্ডে আশ্রয় নেন (৯ই নভেম্বর, ১৯১৮ খ্রিঃ)। জার্মানির বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক নেতা ফ্রেডারিক ইবাৰ্ট-এর নেতৃত্বে ‘সোশালিস্ট ডেমোক্রেটিক দল’ জার্মানিতে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সেখানে একটি সাময়িক প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত করে। জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রজাতন্ত্রকে নানা জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
হিটলারের প্রথম জীবন
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০শে এপ্রিল অস্ট্রিয়ার অন্তর্গত ব্রাউনাউ গ্রামে এক দরিদ্র চর্মকারের গৃহে জার্মান জাতির ‘ফ্যুয়েরার’ অ্যাডলফ হিটলারের জন্ম। পিতা-মাতাকে হারিয়ে অনেকগুলি ভাইবোনকে নিয়ে প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁর বাল্য ও কৈশোরের দিনগুলি অতিবাহিত হয়। সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় ছবি এঁকে এবং হোটেলে পরিচারকের কাজ করে তাঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। কাজের ফাঁকে তিনি ভিয়েনার সরকারি পাঠাগারে পড়াশোনা করতেন। এ সময় তাঁর মনে ইহুদি-বিদ্বেষ ও প্যান-জার্মান বা জার্মান জাতীয়তাবাদের আদর্শ জাগ্রত হয়।
নাতসি দল
ভার্সাই সন্ধি দেশবাসীকে ক্ষুদ্ধ করে এবং সারা দেশে ভাইমার প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে হিটলার ‘জার্মান ওয়ারকার্স পার্টি’ বা জার্মান শ্রমিক দলে যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি এই দলের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হন। কিছুদিন পর এই দলের নতুন নামকরণ হয় ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়াকার্স পার্টি’ বা নাতসি দল। জার্মানরা ‘ন্যাশনাল’ শব্দটির প্রথম দুটি অক্ষর যেভাবে উচ্চারণ করত তা থেকেই এই ‘নাতসি’ সংক্ষিপ্তকরণ।
মাইন ক্যাম্ফ
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত জার্মান সেনাপতি লুডেনডর্ফের সহযোগিতায় বলপূর্বক ভাইমার প্রজাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে হিটলার কারারুদ্ধ হন। কারাকক্ষের নির্জনতায় তিনি রচনা করেন তাঁর আত্মজীবনী- ৭৮২ পৃষ্ঠার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মাইন ক্যাম্ফ’ বা ‘আমার সংগ্রাম’। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থটিতে নাতসি দলের মতাদর্শ, ভাবধারা ও কর্মসূচি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। ‘নাতসি দলের বাইবেল’ বলে চিহ্নিত এই গ্রন্থটির নয় লক্ষ কপি মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বিক্রি হয়।
নাতসি দলের সংগঠন
নাতসি দলের বিভিন্ন শাখা ছিল।
- বেকার যুবকদের নিয়ে গঠিত আধা-সামরিক ঝটিকা বাহিনীকে বলা হত ‘স্টর্ম ট্রুপার্স’। এই বাহিনী নাতসি দলের সভা-সমিতিগুলি পাহারা দিত এবং হামলা চালিয়ে অন্য দলের সভা ভেঙে দিত। এই দলের সদস্যরা বাদামি রঙের পোশাক পরত বলে এদের ‘ব্রাউন শার্টস্’ (Brown Shirts)-ও বলা হত।
- এই বাহিনীর ওপরে ছিল ‘এলিট গার্ডস্’ (Elite Guards)। এদের কাজ ছিল মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে নেতাদের জীবন রক্ষা করা। এ ছাড়া, এদের ওপর নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার অর্পিত হত।
- এই দলে ‘যুববাহিনী’, ‘নারীবাহিনী’, ‘গণ আদালত’, ‘অসামরিক বন্দিশালা’ এবং ‘গেস্টাপো’ বা ‘গুপ্ত পুলিশবাহিনী’-ও ছিল। ‘গেস্টাপো’ নাতসি দলের বহু সমালোচনাকারীকে হত্যা করে। এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন হিমলার।
- নাতসি পতাকা ছিল রক্তবর্ণ এবং তার মাঝে সাদা রঙের মধ্যে শোভা পেত কালো স্বস্তিকা চিহ্ন। লাল রং ছিল ধনতন্ত্র বিরোধিতা, সাদা জাতীয়তাবাদ এবং স্বস্তিকা আর্য রক্তের প্রতীক। তাদের দলীয় মুখপত্রের নাম ছিল ‘পিপলস অবজারভার’।
- তাদের দলীয় সংগীত রচনা করেন হোস্ট ওয়েসেল নামে এক জার্মান যুবক।
- বিখ্যাত জার্মান সংগীতজ্ঞ ভাগনার রচিত ‘জাগ্রত জার্মানি’ ছিল জার্মানির জাতীয় সংগীত।
নাতসি দলের ক্ষমতা লাভ
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের বিশ্বব্যাপী মহামন্দা, মিত্রপক্ষকে প্রদত্ত ক্ষতিপুরণ ও অন্যান্য কারণে জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় আকার ধারণ করে। দলের ঘোষিত লক্ষ্য ও কর্মসূচিতে আকৃষ্ট হয়ে বেকার যুবক, করভারে পীড়িত জার্মান কৃষক, জার্মান ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা নাতসি দলে যোগদান করে। এইভাবে নাতসি দলের জনপ্রিয়তা ও শক্তি প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের জার্মান সংসদ বা ‘রাইখস্ট্যাগ’-এর নির্বাচনে এই দলের আসন সংখ্যা ১২ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০৭-এ পৌঁছায়। ১৯৩২ সালের নির্বাচনে ৬০৮টি আসনের মধ্যে নাতসিরা ২৩০ টি আসন লাভ করে একক বৃহত্তম দলে পরিণত হয়। জার্মান প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ হিটলারকে সরকার গঠনের আহ্বান জানালে তিনি একটি বহুদলীয় সরকার গঠন করেন এবং জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে যুগ্মভাবে চ্যান্সেলার বা প্রধানমন্ত্রী (জানুযারি, ১৯৩৩ খ্রিঃ) নিযুক্ত হন। বহুদলীয় সরকারের শাসন পরিচালনায় নানা অসুবিধার সম্মুখীন হওয়ায় হিটলারের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এই নির্বাচনে (৫ই মার্চ) নাতসি দল, তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হয়। তাই পুনরায় অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলিত হয়ে হিটলারের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়।
একচ্ছত্র নেতা হিটলার
দেশের দুর্দিনে শাসন পরিচালনার সুবিধার জন্য জার্মান সংসদ এক বিশেষ আইন (Enabling Act) পাস করে সংসদের অনুমোদন ছাড়াই হিটলারকে শাসনকাজ পরিচালনা ও আইন প্রণয়নের অধিকার দেয়। এর ফলে কার্যত জার্মানিতে তিনি সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রপতি হিল্ডেনবার্গের মৃত্যু ঘটলে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি দুটি পদ নিজে গ্রহণ করে জার্মান রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন এবং নিজেকে ‘ফ্যুয়েরার’ বা প্রধান নেতা বলে ঘোষণা করেন। ক্ষমতা দখলের পর বিরোধী দল ও নেতৃবৃন্দ- বিশেষত ইহুদি ও কমিউনিস্টদের ওপর নানা দমনপীড়ন শুরু হয়। গ্রেফতার, গুপ্তহত্যা ও অপরাপর নির্যাতনের মাধ্যমে সুব বিরোধিতাকে স্তব্ধ করে দিয়ে হিটলার জার্মানির একচ্ছত্র নেতায় পরিণত হন।