 |
জার্মানির ঐক্য আন্দোলন |
জার্মানির ঐক্য আন্দোলন
সূচনা: ফরাসি বিপ্লবের সময় ইতালির মতো জার্মানিও ছিল একটি ‘ ভৌগোলিক সংজ্ঞা’ মাত্র। জার্মানি একসময় অস্ট্রিয়ার হ্যাপস্বার্গ বংশীয় শাসকদের অধীনে তিনশোটি ক্ষুদ্র-বৃহৎ রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং এই রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বদাই পারস্পরিক বিদ্বেষ ও স্বার্থসংঘাত লেগে থাকত। ফরাসি বীর নেপোলিয়ন জার্মানি জয় করে তিনশোটি রাজ্যের পরিবর্তে জার্মানিকে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ উনচল্লিশটি রাজ্যে পরিণত করেন। এছাড়া বেশ কয়েকটি রাজ্যকে নিয়ে তিনি ‘কনফেডারেশন অব দি রাইন’ বা ‘রাইন রাষ্ট্রসংঘ’ নামে একটি রাষ্ট্র-সমবায় গড়ে তোলেন। এইভাবে নেপোলিয়নের মাধ্যমে জার্মানিতে জাতীয়তাবাদের সূচনা হয় এবং জার্মানি ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারার সঙ্গে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। নেপোলিয়নের পতনের পর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা বৈঠকে সম্মিলিত নেতৃমণ্ডলী ঊনচল্লিশটি রাজ্য নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র-সমবায় বজায় রাখেন ঠিকই, কিন্তু এই রাষ্ট্র-সমবায়ের ওপর অস্ট্রিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অস্ট্রিয়া -এর সভাপতি নিযুক্ত হয়। এর ফলে জার্মান জাতীয়তাবাদীরা হতাশ হন।
সর্ব-জার্মানবাদ
এ সময় ‘প্যান-জার্মানিজম’ বা ‘সর্ব-জার্মানবাদ’ নামে একটি মতাদর্শ জার্মান জাতিকে ঐক্যের পথে এগিয়ে দেয়। ‘সর্ব-জার্মানবাদ’ হল জার্মান জাতিমাত্রেরই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আকাঙ্খা। জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অধ্যাপক এবং বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও ঐতিহাসিক নানাভাবে এই আদর্শকে সঞ্জীবিত করেন। জেনা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী ভাবধারার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবে জার্মানির আরও পনেরোটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় এবং মেটারনিখের দমনমূলক নীতির প্রতিবাদে জার্মানির সর্বত্র গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠতে শুরু করে। ফিক্টে, হেগেল, স্টাইন, বোহেমার, হাসার, ডালম্যান, লিস্ট প্রমুখ মনীষীর রচনা জার্মানদের জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় দীক্ষিত করে।
জোলভেরাইন [Zollverein]
‘জোলভেরাইন’ হল প্রাশিয়ার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত একটি শুল্কসংঘ। জার্মান অর্থনীতিবিদ ম্যাজেন-এর উদ্যোগ এবং প্রাশিয়ার নেতৃত্বে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আগে বিভিন্ন জার্মান রাজ্যে নানা ধরনের আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক প্রচলিত ছিল। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা অসুবিধা দেখা দিত। নবগঠিত এই শুল্কসংঘে যোগদানকারী রাজ্যগুলি বিনা শুল্কে বা নামমাত্র শুল্কে নিজেদের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য চালাত এবং এর ফলে বাণিজ্যিক দিক থেকে তারা যথেষ্ট লাভবান হয়। মূলত অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য গঠিত হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদান ও যোগাযোগের ফলে তাদের মধ্যে ঐক্যবোধ বৃদ্ধি পায়, অর্থনৈতিক ঐক্য রাজনৈতিক ঐক্যের পথ প্রশস্ত করে এবং অর্থনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রাশিয়া জার্মানির রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করে। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত জার্মান সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিল জোলভেরাইন।
ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের সূত্র ধরে জার্মানির হ্যানোভার, হেস, স্যাক্সনি প্রভৃতি স্থানে বিদ্রোহের সূত্রপাত হলে মেটারনিখ তা কঠোর হস্তে দমন করেন। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হলে ইউরোপের সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়ে এবং অস্ট্রিয়া ও জার্মানিতে তা দাবানলের সৃষ্টি করে। মেটারনিখ ছদ্মবেশে ইংল্যান্ডে পলায়ন করেন। জার্মান জাতীয়তাবাদীরা ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্কফোর্ট শহরে এক প্রতিনিধি সভা আহ্বান করে। এটি ‘ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট’ নামে পরিচিত ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং এর জন্য একটি সংবিধান রচনা করা। এই পার্লামেন্ট জার্মানিতে একটি ভাবগত ঐক্য গড়ে তোলে এবং প্রমাণ করে যে, জার্মানির ঐক্যসাধন সম্ভব।
বিসমার্কের উত্থান
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম উইলিয়াম প্রাশিয়ার সিংহাসনে বসেন। তিনি প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানির ঐক্যসাধনের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি অটো ফন বিসমার্ক নামে এক ধুরন্ধর রাজনীতিবিদকে প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। এর ফলে জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে এক নবযুগের সূচনা হয়। বিসমার্ক রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রাশিয়ার রাজতন্ত্রের অধীনেই সমগ্র জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হবে। গণতন্ত্র বা কোনোরকম গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি তাঁর কোনো আস্থা ছিল না। তিনি ঘোষণা করেন যে, “বক্তৃতা বা ভোটের দ্বারা নয়, রক্ত ও লৌহ নীতির দ্বারাই জটিল সমস্যাদির সমাধান হবে।” তিনি উপলব্ধি করেন যে, কেবল সামরিক শক্তির দ্বারাই জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব- অন্য কোনো পথে নয়। এজন্য প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর তিনি প্রাশিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হন। প্রকৃতপক্ষে, সামরিক শক্তির সাহায্যেই তিনি জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ১৮৬৪ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ এই ছয় বছরের মধ্যে তিনটি যুদ্ধের দ্বারা তিনি জার্মানকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এই তিনটি যুদ্ধ হল- (1) ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ (ii) অস্ট্রো-প্রাশিয়া যুদ্ধ (iii) ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়া যুদ্ধ।
(1) ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ: স্লেজউইগ ও হলস্টাইন-কে কেন্দ্র করে ডেনমার্কের সঙ্গে প্রাশিয়ার প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়। স্লেজউইগ ও হলস্টাইন ছিল জার্মানির রাজ্যসীমার অন্তর্ভুক্ত দুটি প্রদেশ, কিন্তু আইনত স্থান দুটি ছিল ডেনমার্কের অধীন। বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন (১৮৬৪ খ্রিঃ)। পরাজিত ডেনমার্ক গ্যাস্টিনের সন্ধি (১৮৬৫ খ্রিঃ) দ্বারা প্রাশিয়াকে স্লেজউইগ এবং অস্ট্রিয়াকে হলস্টাইন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
(ii) অস্ট্রো-প্রাশিয়া যুদ্ধ: বিসমার্ক জানতেন যে, জার্মানির ঐক্যের জন্য অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ অপরিহার্য। তাই তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি শরু করেন এবং ইউরোপীয় রাজনীতিতে অস্ট্রিয়াকে মিত্রহীন করতে সচেষ্ট হন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। স্যাডোয়ার যুদ্ধে (১৮৬৬ খ্রিঃ) অস্ট্রিয়া শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। প্রাগের সন্ধি (২৩শে আগস্ট) দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। সন্ধির শর্তানুসারে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে গঠিত জার্মান রাষ্ট্রসংঘের বিলুপ্তি ঘটে, স্লেজউইগ-হলস্টাইন প্রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়, হ্যানোভার, ক্যাসেল ও প্রাশিয়ার নেতৃত্বে উত্তর জার্মান রাষ্ট্রসংঘ গঠিত হয়।
(iii) ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়া যুদ্ধ: স্যাডোয়ার যুদ্ধের ফলে উত্তর জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু দক্ষিণ জার্মানির ফরাসি প্রভাবাধীন স্থানগুলির ঐক্য তখনও বাকি ছিল। স্যাডোয়ার যুদ্ধের ফলে ফ্রান্সের পাশে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে প্রাশিয়ার উন্মেষ ফরাসিরা ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। তারা প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য জেনে বিসমার্ক যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই জুলাই ফ্রান্স প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সেডানের যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় (সেপ্টেম্বর, ১৮৭০)। ফ্রাঙ্কফোর্টের সন্ধি (১০ই মে, ১৮৭১ খ্রিঃ) দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। ফ্রান্স প্রাশিয়াকে মেজ ও আলসাস-লোরেন ছেড়ে দিতে এবং প্রচুর অর্থ ক্ষতিপূরণ দিতে স্বীকৃত হয়। প্রাশিয়া-রাজ প্রথম উইলিয়ম ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সম্রাট বা ‘কাইজার ‘বলে ঘোষিত হন।
এমস্ টেলিগ্রাম [Ems Telegram]
জার্মানির ঐক্যের জন্য ফ্রান্সের সঙ্গে প্রাশিয়ার যুদ্ধ অপরিহার্য ছিল। বিসমার্ক যুদ্ধের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এই সময়ে স্পেনের সিংহাসনে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন নিয়ে এক গোলযোগের সূত্রপাত হয়। স্পেনবাসী প্রাশিয়ার হোহেনজোলার্ন বংশের প্রিন্স লিওপোল্ড-কে স্পেনের রাজপদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলে ফ্রান্সে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন প্রাশিয়া-রাজ প্রথম উইলিয়মের কাছ থেকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চান যে, হোহেনজোলার্ন বংশের কেউ কখনও স্পেনের সিংহাসনে বসবে না। এই উদ্দেশ্যে ফরাসি দূত কাউন্ট বেনিদিতি এস নামক স্থানে বিশ্রামরত প্রাশিয়া-রাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রাশিয়া-রাজ এ ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতিদানে তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করেন এবং পুরো বিষয়টি টেলিগ্রাম মারফত প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ককে জানান (১৩ই জুলাই, ১৮৭০ খ্রিঃ)। কূটকৌশলী বিসমার্ক মূল টেলিগ্রামের কিছু শব্দ বাদ দিয়ে সেটি এমনভাবে সাজিয়ে পরের দিন সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন, যাতে মনে হয় যে প্রাশিয়া-রাজ ফরাসি দূতকে অপমান করেছেন। এতে ফরাসি জনমত প্রবলভাবে বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং তারা তাদের জাতীয় অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দাবি করতে থাকে। ইতিহাসে এই ঘটনা ‘এম্স্ টেলিগ্রাম’ নামে খ্যাত।