![]() |
তোমার জীবনের লক্ষ্য রচনা |
ভূমিকা
‘হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’, সে যেমন লক্ষ্যভ্রষ্ট, তেমনি একজন লক্ষ্যহীন মানুষও অপূর্ণ। আর এই অপূর্ণতা মানুষকে তার বাঞ্ছিত লক্ষ্য পূরণের পথে পৌঁছে দিতে পারে না। ফলে তার জীবন হয়ে ওঠে বিষময়। তাই আমি আমার জীবনের লক্ষ্য সম্বন্থে সচেতন। আমি বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে চাই। কেননা আমাদের গ্রামে বহু মানুষ সুচিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করে। আর এই লক্ষ্যকে আমি ধ্রুবতারার মতো স্থিরভাবে গ্রহণ করেছি, তার কোনোরকম পরিবর্তন আমি চাই না। যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে আমি আমার লক্ষ্যে স্থির থাকতে চাই।
লক্ষ্য গ্রহণের প্রেক্ষাপট
আলোকার্থীকে আলোক পেতে হলে যেমন আলোর উপযোগী সলতে নির্মাণ করতে হয়, তেমনি মানুষকে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে প্রয়োজন লক্ষ্যে পৌঁছবার পূর্বে যথার্থ মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ। যথার্থ প্রস্তুতির মধ্যেই নিহিত থাকে সাফল্যের চাবিকাঠি। তেমনি আমার এই পেশা নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্ব ছিল প্রাসঙ্গিক। সেই প্রাসঙ্গিক পথ হল, যখন আমি প্রাথমিক স্কুলে পড়ি, তখন আমার জ্ঞাতি এক দাদা যেভাবে সুচিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন, সেই স্মৃতি এখনো আমাকে তাড়া করে। সেই অল্প বয়সে শুধু আমার দাদা নয়, অনেক মানুষকে বিনা চিকিৎসায় কিম্বা হাতুড়ে ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায় মরতে হয়েছে। কারণ আমাদের আশেপাশের গ্রামে কোনো হাসপাতাল তো ছিলই না, ছিল না কোনো পাশ করা ডাক্তার। সেইসঙ্গে কাঁচা রাস্তায়, বিদ্যুৎহীন গ্রামে রাতে কারোর অসুখ হলে ভগবানের উপর ভরসা করে বসে থাকতে হত। তাই প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমার মনে একটা লক্ষ্য ছিল যে, বড়ো হয়ে ভালো পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়ে আমার গ্রামের মানুষের সেবা করব।
লক্ষ্য নির্বাচনে যুক্তি
আমার বাবার ইচ্ছা ছিল আমি একজন তাঁর মতো ভাল কৃষক হই। তাঁর মতে- চাষার ছেলে চাষা হওয়াই ভালো। প্রথমে প্রথমে ভাবতাম, আমাদের দেশ যেহেতু কৃষিপ্রধান, তাই কৃষির উন্নতিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে দেশ লাভবান হত। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলাম এই কারণে যে, একজন মানুষ শুধু খাদ্যের জন্য বাঁচে না, বাঁচে সুস্বাস্থ্যের কারণে, স্বাস্থ্য চেতনার জন্য। তাই একজন ডাক্তার হলে আমি শুধু চিকিৎসার কাজই করতে পারব না, স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্বন্ধে তথা স্বাস্থ্য চেতনা সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করতে পারব। তাছাড়া আমি ছেলেবেলা থেকেই লক্ষ্য করেছিলাম, গ্রামের বহু মানুষ পুকুরের জল খায়, বনে-বাদাড়ে, পুকুরপাড়ে বাহ্য প্রস্রাব করে, পুকুরে গবাদি পশুকে স্নান করায়, কলেরা হলে রোগীর জামাকাপড় পুকুরে কাচে আবার সেই পুকুরের জলই পান করে, সাপে কামড়ালে ওঝার কাছে যায়, মায়েদের সন্তান প্রসবের জন্য ধাইমাদের সাহায্য নেওয়া হয়, সেজন্য মা হতে গিয়ে বহু মা মারা যান-এসব ঘটনা আমাকে এই লক্ষ্য গ্রহণে বাধ্য করেছে। আবার এও মনে হয়েছে আমার মতো চাষির ছেলে, যাদের বংশে কেউ এমন জীবিকা গ্রহণ করেনি, তার পক্ষে এই ধরনের ব্যয়সাপেক্ষ লক্ষ্য গ্রহণ উচিত হয়েছে কিনা-সে বিষয়ে দ্বন্দ্ব যে উপস্থিত হয়নি তা নয়। তবুও মনের জোর এবং আমার মায়ের প্রেরণা আমাকে এই লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। আমি জানি, আমার মনের উদ্যম ও ইচ্ছাশন্তিই প্রধান কথা। কারণ ‘উদ্যোগিনং পুরুষসিংহং মুপৈতি লক্ষ্মী’ অর্থাৎ উদ্যোগী পুরুষেরাই লক্ষ্মী লাভ করতে পারে।
লক্ষ্য পূরণের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা
স্বপ্ন দেখা যত সহজ, তাকে বাস্তবে রূপায়িত করা তত কঠিন। স্বপ্নভঙ্গের শিকার আমি হতে চাই না বলেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেবার জন্য আমি দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাই।
শুধু তাই নয়, আমি ডাক্তার হয়ে কি কি করতে চাই সে বিষয়ে আমি আমার ইতিকর্তব্য ঠিক করে রেখেছি। যেমন, প্রথমেই আমি আমার গ্রামের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যচেতনা গড়ে তোলবার জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে চাই-যার দ্বারা গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়ির লোকেরা সচেতন হতে পারে। সরকারি অর্থে কিম্বা গ্রামের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় একটি দাতব্য চিকিৎসালয় গড়তে চাই-যেখানে প্রতিদিন মানুষেরা আসবে চিকিৎসার জন্য। যে কোনো সময় যে কোনো ব্যক্তি চিকিৎসার জন্য ডাকলে আমি চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে ইতস্তত করব না। দুঃস্থ ও গরিব লোকেদের কাছ থেকে কোনো পয়সা না নিয়ে চিকিৎসা করার ব্রতও গ্রহণ করেছি। গ্রামের মানুষদের যে সব কুসংস্কার আছে, তা দূর করতে বদ্ধপরিকর হব। সর্বোপরি ত্যাগেই সুখ, ভোগেই দুঃখ-ভারতবর্ষের এই শাশ্বত বাণীকে সামনে রেখে আর্তের সেবায় নিয়োজিত করাই হবে আমার জীবনের মূল ব্রত।
উপসংহার
যে কোনো লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে চাই উদ্যম ও সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি। এই মানসিকতা নিয়ে আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকব। কোন কিছুর বিনিময়ে আমি যেন সত্যভ্রষ্ট না হই-এই হবে আমার একমাত্র কামনা। আমার স্থির বিশ্বাস আমাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে-এই আশাই আমাকে পথ দেখাবে।