থুকিডিডিস কে ছিলেন? থুকিডিডিসের ইতিহাসচেতনা ও রাষ্ট্রভাবনার বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো

থুকিডিডিস কে ছিলেন? থুকিডিডিসের ইতিহাসচেতনা ও রাষ্ট্রভাবনার বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো

থুকিডিডিসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও গ্রন্থ রচনা

আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ ছিলেন থুকিডিডিস (৪৫০/৪৬০-৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। হেরোডোটাসের রচনার অবাস্তব ধারণা, কল্পনা ইত্যাদি বর্জন করে তথ্যনিষ্ঠ ও নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস রচনার সূচনা করেন থুকিডিডিস। হেরোডোটাসের জন্মের প্রায় ২৫ বছর পরে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ (মতান্তরে ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নাগাদ এথেন্সের এক অভিজাত পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। ৪২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেনাধ্যক্ষ হিসেবে উত্তর ইজিয়ানের থ্রেস অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তিনি। তবে পরবর্তীতে সামরিক ব্যর্থতার কারণে থুকিডিডিসকে এথেন্স থেকে নির্বাসিত করা হয়। আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তিনি পরলোকগমন করেন। থুকিডিডিসের বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ পেলোপনেসীয় যুদ্ধের ইতিহাস। এর বিষয়বস্তু হল, এথেন্সের সঙ্গে স্পার্টার নেতৃত্বে গঠিত গ্রিক রাষ্ট্রজোটের লড়াই।

ইতিহাসচেতনা ও রাষ্ট্রভাবনার বৈশিষ্ট্য

থুকিডিডিস রচিত গ্রন্থের মাধ্যমে মূলত তাঁর ইতিহাসচেতনা ও রাষ্ট্রভাবনার বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটে উঠেছে।

ইতিহাসচেতনা

(i) রচনাশৈলী

গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে তিনি সংক্ষিপ্ত, সুনির্দিষ্ট অথচ প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ লিপিবদ্ধকরণের পক্ষপাতী ছিলেন। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে তিনি এমন ভাষা ও অলংকার ব্যবহার করেছেন যার দরুন তাঁর রচনাশৈলী অকারণে ভারাক্রান্ত ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে।

(ii) কালানুক্রমিকতা

ইতিহাস রচনা বা চেতনার ক্ষেত্রে কালানুক্রম মান্য করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে গণ্য করা হয়। থুকিডিডিসও তাঁর এই গ্রন্থে কালানুক্রম অনুসারে ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহকে সাজানোর চেষ্টা করেছেন। ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধের কাহিনি লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এক্ষেত্রে তিনি হেরোডোটাসের রচনারীতিকে অনুসরণ না করে সম্পূর্ণ নতুনভাবে এবং এককথায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন দ্বারা ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন।

(iii) তথ্যনিষ্ঠ রচনা

থুকিডিডিসের রচনা থেকে তাঁর তথ্যনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি শুধুমাত্র যুদ্ধসংক্রান্ত ঘটনাবলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাই দেননি, নিজের ধারণা অনুযায়ী সত্যকে বিশ্লেষণ করে সেগুলি উপস্থাপনও করেছেন। আধুনিক গবেষকমহলে অবশ্য বিষয়টি বিতর্কিত।

(iv) বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি

ইতিহাসচর্চায় বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। সুসংহত তথ্যের ব্যবহারের সঙ্গে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রচেষ্টা তাঁর বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। যুদ্ধের ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় তিনি যেভাবে কালানুক্রম মেনে গ্রন্থ রচনা করেছেন তা প্রশংসার যোগ্য। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী এ প্রসঙ্গে বলেছেন যে- ‘তিনি ইতিহাসকে ব্যক্তিগত কাহিনির অনুক্রম বলে ভাবেননি; ইতিহাসকে দেখেছেন বিচিত্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তির ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াপ্রসূত প্রবাহরূপে।

রাষ্ট্রভাবনা

ঐতিহাসিক এডিথ হ্যামিলটনের (Edith Hamilton) মতে, থুকিডিডিসের ইতিহাসে দুটি প্রধান ধারা লক্ষণীয়- একদিকে নির্মোহভাবে ঘটনাবলির বর্ণনার প্রবণতা ও নিরাসক্তভাবের আড়ালে সমকালীন ঘটনা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মতপ্রকাশ। এদিক থেকে বিচার করলে থুকিডিডিসকে নিজের সময়কালের রাষ্ট্র ও সমাজের নানান ঘাতপ্রতিঘাতের একজন প্রথম শ্রেণির ভাষ্যকার বলা যেতে পারে।

(i) নৈতিকতা সম্পর্কে অভিমত

থুকিডিডিস সমগ্র গ্রিক জনজীবনে নৈতিকতার অবক্ষয়ের জন্য পেলোপনেসীয় যুদ্ধকে দায়ী করেছেন। এই নৈতিক বিপর্যয়ে তিনি ভীষণভাবে মর্মাহত হন। তিনি দেখিয়েছেন যে কীভাবে ৪২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ নিকিয়াসের শান্তিচুক্তির সময়ে এথেন্সের বণিক শ্রেণি যাবতীয় মূল্যবোধ পরিত্যাগ করেছিল। এ ছাড়াও স্বার্থপরতার রাজনীতির জন্য সমকালীন ডেমাগগদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। কিন্তু অন্যদিকে মধ্যস্তরীয় নেতা নিকিয়াসকে সদয় হৃদয়, এথেনীয় মূল্যবোধের সমন্বয় বলে প্রশংসাও করেছেন।

(ii) গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা

থুকিডিডিস গণতান্ত্রিক রীতিনীতির তুলনায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাঠামোর প্রতি বেশি বিশ্বাস রাখতেন। পেরিক্লিসের সাম্রাজ্যবাদের মোড়কে গঠিত গণতন্ত্রকে তিনি শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন। অনেকের মতে, থুকিডিডিস গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মুষ্টিমেয়তন্ত্রী এবং আরও বিশেষভাবে বললে পেরিক্লিসের সমর্থক। ওয়েড-গ্রে এই গুণমুগ্ধতা প্রসঙ্গে বলেছেন- পেরিক্লিসের জাদুতে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছন্ন।’ তবে থুকিডিডিস ৪৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পেরিক্লিসের অনুমোদিত আইন দ্বারা এথেনীয় নাগরিকদের সংখ্যা কমিয়ে আনার আইনের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে সেটিকে অগণতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করতেও ভোলেননি।

(iii) রাষ্ট্র ও নাগরিক সম্পর্কে অভিমত

থুকিডিডিস মনে করতেন যে, মানুষের মধ্যে দুটি বিষয় সক্রিয় আছে- ফিসিস (Physis) এবং নোমস (Nomos)। গ্রিক ভাষায় ফিসিস হল মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি যা স্বাভাবিক ও প্রকৃতিদত্ত। এর বিপরীতে আছে নোমস অর্থাৎ মনুষ্যসৃষ্ট সামাজিক প্রথা বা আইন। তাঁর মতে, আইন ভঙ্গ করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কারণ- নোমস কৃত্রিমভাবে মানুষের উপর আরোপিত। সংকটকালে যখন আইন মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, তখন মানুষ অন্তর্নিহিত শক্তি বলে (ফিসিস) সামাজিক আইন ভাঙতে দ্বিধা করে না। সবল দুর্বলের উপর অত্যাচার করে। তাই দুর্বল সুযোগ পেলেই সবলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। মানবচরিত্রের এই সর্বজনীন প্রেক্ষাপটে শাসক ও শাসিতের বা রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক বিচার করে তিনি রাষ্ট্রতত্ত্বের একটা সম্ভাব্য দিকনির্দেশ করেছেন।

পরিশেষে বলা যায়, থুকিডিডিসের ইতিহাস রচনার বাস্তবধর্মিতা, সফিস্টসুলভ যুক্তিবাদ, বাস্তববাদের উপর গুরুত্ব প্রদান এবং রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ইতিহাসে তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

আরও পড়ুন – গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

Leave a Comment