![]() |
নিষ্কাম কর্মের বিরুদ্ধে যুক্তিগুলি কী |
নিষ্কাম কর্মের বিরুদ্ধে যুক্তি
গীতার নিষ্কাম কর্মের বিষয়টিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত করা হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে তার ব্যাখ্যা ও বিচার করাও হয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্নরকম যুক্তির উপস্থাপনা করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা যায় যে, এরূপ নীতিটি কখনোই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কারণ, গীতার নিষ্কাম কর্মের ক্ষেত্রে নিম্নের সমালোচনাগুলিকে উপস্থাপিত করা যায়।
প্রথমত: অর্থহীন ও অবাস্তব প্রয়াসরূপে নিষ্কাম কর্ম
গীতোক্ত নিষ্কাম নীতিতত্ত্বের বিষয়টি মনোবিজ্ঞান এবং পাশ্চাত্য নীতিতত্ত্বের সাধারণ নিয়মের বিরোধী। কারণ, এরূপ নীতিতত্ত্বের ক্ষেত্রে দাবি করা হয় যে, ফলের আকাঙ্ক্ষা না-করেই মানুষকে কর্ম করতে হবে। কিন্তু মনোবিজ্ঞান এবং নীতিবিজ্ঞানের সাধারণ সূত্রে বলা হয়েছে যে, মানুষের প্রত্যেকটি কর্মের পিছনেই কোনো-না- কোনো একটি উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। এই উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কাজই সম্পাদিত হতে পারে না। উদ্দেশ্যকেই তাই কর্মপ্রেরণার উৎস বলা হয়। কিন্তু নিষ্কাম কর্মের ক্ষেত্রে কোনো উদ্দেশ্য না থাকায় তার সম্পাদন অর্থহীনরূপে গণ্য। সুতরাং নিষ্কাম কর্মের নীতিতত্ত্বটি একটি অর্থহীন, অসম্ভব ও অবাস্তব প্রয়াসরূপে গণ্য।
দ্বিতীয়ত: উদ্ভট তত্ত্বরূপে নিষ্কাম কর্ম
নিষ্কাম নীতিতত্ত্বের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঈশ্বরই হলেন আমাদের সমস্ত প্রকার কর্মের নিয়ামক, আমরা নই। অর্থাৎ, আমরা কর্ম সম্পাদন করলেও কর্মফলের কোনো অধিকার আমাদের নেই। এরূপ ব্যাপারটি কিন্তু একটি উদ্ভট বিষয়রূপে গণ্য। কারণ, কর্ম করলে তার ফল থাকবেই। কর্মফল তাই কখনোই কর্ম থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। অথচ আমাদের শুধু কর্ম করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, কর্মফলের কোনো অধিকার দেওয়া হয়নি। কর্ম থেকে কর্মফলকে তাই বিচ্যুত করা হয়েছে। এরূপ বিষয়টিকে কখনোই যুক্তিবিজ্ঞানের দিক থেকে সমর্থন করা যায় না। সেকারণেই দাবি করা সংগত যে, গীতার নিষ্কাম কর্মের বিষয়টি একটি উদ্ভট ও অযৌক্তিক প্রয়াসরূপে গণ্য।
তৃতীয়ত: স্বাধীন চিন্তাবৃত্তিতে নিষ্কাম কর্মের অচলতা
নিষ্কাম কর্মের নীতিতত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি বিরাট অভিযোগ এই যে, এখানে মানুষকে যন্ত্র এবং ঈশ্বরকে যন্ত্রীরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, মানুষ কর্ম করলেও, কর্ম করার পরিকল্পনা কিন্তু ঈশ্বরের। আবার শুধু কর্ম করার ওপর মানুষের অধিকার দেওয়া হলেও, কর্মফলের ওপর কোনো অধিকার দেওয়া হয়নি। কর্মফলের অধিকার কেবল ঈশ্বরের। ঈশ্বরই হলেন একমাত্র পরিকল্পনাকারী এবং সেকারণেই তিনি আমাদের সমস্ত প্রকার কর্মের পরিকল্পনা করেন এবং তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ীই মানুষ চালিত হয় যন্ত্রের মতো। কিন্তু মানুষের যেহেতু স্বাধীন চিন্তাবৃত্তি আছে, সেহেতু মানুষকে কখনোই যন্ত্রবৎ পর্যবেক্ষণ করা উচিত নয়। আর তা যদি হয়, তাহলে নিষ্কাম কর্মের প্রক্রিয়াটি একেবারেই অচল হয়ে পড়ে।
চতুর্থত: জগতের দৈন্যদশায় নিষ্কাম কর্মের অযথার্থতা
নিষ্কাম কর্মের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমাদের সমস্ত প্রকার কর্মের ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করতে হয়। কারণ, তা না-করলে, আমাদের মনে কর্তৃত্বাভিমান এবং ফলাকাঙ্ক্ষার ভাবটি জাগরিত হয়। এরূপ বিষয়টি যদি সত্য হয়, তাহলে জগতের সমস্ত কিছুই ঈশ্বরময়রূপে গণ্য হওয়া উচিত। ফলত জগতের সমস্ত প্রকার কর্মই শুভদায়ক, মঙ্গলজনক ও আনন্দপূর্ণরূপে প্রতিভাত হওয়া উচিত। কিন্তু জগতে আমরা অবিমিশ্র শুভ, মঙ্গল ও আনন্দদায়ক কিছুই পর্যবেক্ষণ করি না। শুভের সঙ্গে অশুভের, মঙ্গলের সঙ্গে অমঙ্গলের, আনন্দের সঙ্গে নিরানন্দ প্রভৃতি পর্যবেক্ষণ করি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, জগতের সমস্ত কিছুই যদি ঈশ্বরের পরিকল্পনাপ্রসূত হয় তাহলে জগতের এরূপ দৈন্যদশা কেন? এর কোনো সদুত্তরই আমরা পাই না এবং সেকারণেই নিষ্কাম কর্মের নীতিতত্ত্বের বিষয়টিকে সমর্থন করা যায় না।
পঞ্চমত: অতিমাত্রিক কল্পনায় নিষ্কাম কর্ম
নিষ্কাম কর্মের নীতিতত্ত্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিষ্কামভাবে কর্ম করার জন্য মানুষকে স্থিতধীর নীতি গ্রহণ করতে হয়। যিনি সুখেতে আসক্ত নন আবার দুঃখেও উদ্বিগ্ন নন, ভয় এবং ক্রোধ-এই উভয় রিপু থেকেই যিনি মুক্ত এবং লাভ ও অলাভের হিসাব যিনি করেন না- সেরূপ ব্যক্তিই হলেন স্থিতধী ব্যক্তি। এরূপ স্থিতধী ব্যক্তিরাই শুধু নিষ্কামভাবে কর্মসম্পাদনে সমর্থ, অপর কেহ নন। কিন্তু গীতার কল্পনায় এরূপ স্থিতধী ব্যক্তির অস্তিত্ব কখনোই বাস্তবের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। কারণ, যাবতীয় রিপুকে দমন করেছেন এমন ব্যক্তির দেখা মেলা বাস্তবে অসম্ভব। সুতরাং দেখা যায় যে, স্থিতধীর কল্পনা এবং নিষ্কাম কর্মের কল্পনা এক অতিমাত্রিক কাল্পনিক মতবাদরূপেই গণ্য। বাস্তবে এরূপ বিষয় একেবারেই নিরর্থক।