নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে কান্টের নৈতিক নিয়মের তুলনা করো

নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে কান্টের নৈতিক নিয়মের তুলনা করো
নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে কান্টের নৈতিক নিয়মের তুলনা করো

নিষ্কাম কর্ম ও কান্টের নৈতিক নিয়মের তুলনা

আপাতদৃষ্টে দুটি মতবাদের সাযুজ্য বা মিল: নিষ্কাম নীতিতত্ত্বের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কান্টের নৈতিক নিয়মটির আলোচনাও করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ, তা না হলে, নিষ্কাম কর্মের নৈতিকতা সম্পর্কে আমাদের একপ্রকার ভ্রান্তির সম্ভাবনা থেকেই যায়। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হয় যে, নিষ্কাম কর্মের নৈতিকতার সঙ্গে কান্টের নৈতিক নিয়মের একপ্রকার সাযুজ্য আছে। কারণ, গীতার নিষ্কাম নীতিতত্ত্বের ক্ষেত্রে যে মৌল উদ্দেশ্যটি পরিলক্ষিত হয়, তা হল-নিষ্কামভাবে নিরন্তর কর্ম করা। এখানে একদিকে যেমন কর্মপ্রেরণার বিষয়টি স্বীকৃত হয়েছে, অপরদিকে তেমনই কর্মফলের প্রতি নিরাসক্ত হওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কান্টের নীতিতত্ত্বের ক্ষেত্রেও আবার ব্যতিক্রমহীনভাবে শর্তহীন আদেশ বা অনুজ্ঞার বিষয়টি ঘোষিত হয়েছে। কান্টের নীতিদর্শনে অনুরূপভাবে সদিচ্ছার কথাও উল্লিখিত হয়েছে। নিষ্কাম নীতিতত্ত্বে ঈশ্বরে সর্বকর্ম সমর্পণ করা যেমন মানুষের স্বেচ্ছাধীন বিষয়রূপে গণ্য, তেমনই কান্টের নীতিতত্ত্বেও সদিচ্ছার বিষয়টিও স্বেচ্ছাধীন বিষয়রূপে গ্রাহ্য। গীতোক্ত নিষ্কাম নীতিতত্ত্বে যেমন ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জনের কথা বলা হয়েছে, তেমনই কান্টের নীতিতত্ত্বেও কর্তব্যের জন্য কর্তব্য-এর বিষয়টিও ঘোষিত হয়েছে। সেকারণেই আপাতদৃষ্টিতে কান্টের নীতিতত্ত্বের সঙ্গে নিষ্কাম নীতিতত্ত্বের একপ্রকার মিল দেখা যায়।

সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে এদের পার্থক্য

সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যায় যে, নিষ্কাম নীতিতত্ত্ব এবং কান্টের নীতিতত্ত্বের মধ্যে সাযুজ্য রচনা করা ঠিক নয়। কারণ, এই দু-প্রকার নীতিতত্ত্বের মধ্যে যে সাযুজ্য রচনা করা হয়েছে, তা অবশ্যই আপেক্ষিকরূপে গণ্য, কখনোই সার্বিকভাবে গ্রাহ্য নয়। এদের মধ্যে কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও তা এতটাই ন্যূনতম যে, এর ভিত্তিতে কোনো তত্ত্বকেই দাঁড় করানো যায় না। কান্টের নৈতিকতা সম্পর্কিত ধারণা যা ‘কর্তব্যের জন্য কর্তব্য’ নীতির মাধ্যমে প্রকাশিত-সেক্ষেত্রে একপ্রকার স্বার্থবোধের মনোভাব বিদ্যমান। কারণ, এক্ষেত্রে কান্ট সৎকর্মের সঙ্গে সুখের সামঞ্জস্যবিধানের ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু নিষ্কাম নীতিতত্ত্বের ক্ষেত্রে স্বার্থবোধের মনোভাবটি একবারেই অনুপস্থিত। সুতরাং, নিষ্কাম কর্মের নৈতিকতাকে কখনোই কান্টের নৈতিক মতবাদের সঙ্গে একাসনে বসানো যায় না। কান্টের নীতিতত্ত্ব অপেক্ষা নিষ্কাম নীতিতত্ত্বের বিষয়টি আরও অনেক উচ্চ আদর্শগত নৈতিকতার আসনে অধিষ্ঠিত।

আনন্দসিক্ত মতবাদে নিষ্কাম কর্ম কিন্তু শুষ্ক মতবাদে কান্টের নৈতিকতা

আরও উল্লেখ করা যায় যে, কান্টের নীতিতত্ত্বের মৌল উৎস হল বিবেকের প্রেরণা ও নির্দেশ। সেক্ষেত্রে এক ধরনের বাধ্যবাধকতার ভাব নিহিত আছে। কিন্তু, গীতোক্ত নিষ্কাম কর্মের ধারণায় কোনো বাধ্যবাধকতার ভাব নেই। অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে নিষ্কাম নীতিতত্ত্বের ক্ষেত্রে। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, শুধু অন্তরের প্রেরণার দ্বারাই নিষ্কাম কর্মের নৈতিকতার বিষয়টি নির্ধারিত হতে পারে না। এই অন্তরের প্রেরণার সঙ্গে আরও কিছু থাকা দরকার, যেমন ব্যক্তির নিজের স্বরূপ, জগতের স্বরূপ এবং ঈশ্বরের স্বরূপ প্রভৃতি। এই সমস্ত বিষয়ের সম্মিলিত রূপের মাধ্যমেই নিষ্কাম কর্মের বিষয়টি সম্পর্কিত হতে পারে। এর ফলে নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে মানুষ পরমানন্দের অনুভূতি লাভ করতে পারে। গীতার নিষ্কাম কর্মের ধারণাটি তাই পরিশেষে একটি আনন্দসিক্ত মতবাদে পরিণত। কিন্তু কান্টের নৈতিক মতবাদটি কখনোই সেরূপ নয়। তা হল এমনই এক নৈতিক মতবাদ, যা একটি শুষ্ক ও কাঠিণ্যপূর্ণ মতবাদে পরিণত। সুতরাং, সিদ্ধান্ত করা সংগত যে, গীতার নিষ্কাম কর্মের শুষ্ক ও কাঠিণ্যপূর্ণ মতবাদে পরিণত। সুতরাং সিদ্ধান্ত করা সংগত যে, গীতার নিষ্কাম কর্মের নৈতিকতাকে কান্টের নৈতিক মতবাদের সঙ্গে এক করে দেখা উচিত নয়।

Leave a Comment