নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য কী তা উল্লেখ করো – আজকের পর্বে নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য কী তা আলোচনা করা হল।
নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য কী তা উল্লেখ করো
 |
নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য কী তা উল্লেখ করো |
নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্য
নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নের বিষয়গুলিকে উল্লেখ করা যায়।
বিজ্ঞান হিসেবে নীতিবিজ্ঞান
প্রথমেই উল্লেখ করা যায় যে, নীতিবিজ্ঞান হল এক ধরনের বিজ্ঞান। কারণ, বিজ্ঞানের অর্থ হল প্রকৃতির একটি বিশেষ বিভাগ নিয়ে সুশৃঙ্খল, সুসংবদ্ধ, যুক্তিনির্ভর ও সুনিয়ন্ত্রিত জ্ঞান আহরণ করা। লৌকিক বা সাধারণ জ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানের পার্থক্য এখানেই। কারণ, সাধারণ বা লৌকিক জ্ঞান হল অসংবদ্ধ, যুক্তিহীন ও অনিয়ন্ত্রিত। লৌকিক বা সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা যে-সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান পাই তা এলোমেলো। প্রকৃতিতে যখন যেভাবে জ্ঞানের বিষয়টিকে পাওয়া যায়, আমরা তখন সেইভাবে ওই বিষয়ের জ্ঞান পেয়ে থাকি। এক্ষেত্রে বিষয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতা আমাদের থাকে না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিষয়ের জ্ঞানটি সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের সামনে হাজির হয় এবং সেই বিষয় সম্পর্কে আমরা বিশেষভাবে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য ও যুক্তিনির্ভর জ্ঞান পেয়ে থাকি।
আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞানরূপে নীতিবিজ্ঞান
নীতিবিজ্ঞানকে একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলা হয়। বিজ্ঞানকে সাধারণত দু-ভাগে বিভক্ত করা হয়- বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান ও আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানের কাজ হল কোনো বিষয় বা ঘটনাকে ঠিক যেমন ঘটে, সেইভাবে ব্যাখ্যা করা। অর্থাৎ বলা যায় যে, এই ধরনের বিজ্ঞানের কাজ হল কোনো ঘটনার যথাযথ আনুপূর্বিক বর্ণনা করা। ঘটনাগুলি ঠিক যেমনভাবে ঘটে, সুেগলিকে ঠিক সেইভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়। এক্ষেত্রে ঔচিত্যের কোনো স্থান নেই। ঘটনার যথাযথ বর্ণনাই হল এর মূলকথা। সেকারণেই বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানকে বর্ণনামূলক বিজ্ঞানরূপে (Descriptive Science) গণ্য করা হয়।
নীতিবিজ্ঞানকে কখনোই বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানরূপে গণ্য করা যায় না। কারণ, এক্ষেত্রে সামাজিক মানুষের আচরণের আনুপূর্বিক বর্ণনা দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে নীতিবিজ্ঞানের কাজ হল সামাজিক মানুষের আচরণগুলিকে ভালো-মন্দ, ন্যায়- অন্যায় এই ধরনের ঔচিত্যমূলক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারবিশ্লেষণ করা। অর্থাৎ, মানুষের আচার-আচরণ ঠিক কেমন হওয়া উচিত-এরূপ আলোচনাই করা হয় নীতিবিজ্ঞানে এবং সেকারণেই নীতিবিজ্ঞানকে আদর্শমূলক বিজ্ঞানরূপে গণ্য করা হয়।
মানুষের নৈতিক আচরণের আলোচনারূপে নীতিবিজ্ঞান
নীতিবিজ্ঞান ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ প্রভৃতি আদর্শের আলোকে যার বিচার- বিশ্লেষণ করে তা হল মানুষের আচার-আচরণ, কখনোই মনুষ্যতর প্রাণীর আচার- আচরণ নয়। নীতিবিজ্ঞান তাই পিতামাতাকে ভক্তি করা সন্তানের উচিত কর্তব্য-এরূপ ঔচিত্যমূলক নীতির কথাই বলতে পারে। কিন্তু নীতিবিজ্ঞান কখনোই এরূপ কথা বলে না যে, কুকুরের প্রভুকে ভক্তি করা উচিত। এর মূল কারণ হল যে, আমরা নীতিবিজ্ঞানে শুধুমাত্র মানুষের ঐচ্ছিক ক্রিয়ারই নৈতিক বিচার করি, ঐচ্ছিক ছাড়া আর কোনো প্রকার ক্রিয়ার নৈতিক বিচার করা হয় না। আর প্রাণীকূলের মধ্যে শুধুমাত্র মানুষের মধ্যেই বুদ্ধিদীপ্ত ঐচ্ছিক ক্রিয়ার বিষয় লক্ষ করা যায় বলেই, সেগুলির নৈতিক বিচার করা হয়। সুতরাং বলা যায় যে, নীতিবিজ্ঞানে শুধুমাত্র মানুষের আচার-আচরণেরই নৈতিক বিচার করা হয়, মনুষ্যতর প্রাণীর আচার-আচরণের কোনো নৈতিক বিচার করা হয় না।
সামাজিক মানুষের আচরণের নৈতিক বিচারে নীতিবিজ্ঞান
এ কথা ঠিক যে, নীতিবিজ্ঞান শুধুমাত্র মানুষের আচার-আচরণকেই নৈতিকভাবে বিচার করে। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, নীতিবিজ্ঞান যে-কোনো মানুষের আচার- আচরণের নৈতিক বিচার করে না। তা শুধুমাত্র সামাজিক মানুষেরই আচার- আচরণের নৈতিক বিচার করে। অর্থাৎ যে-সমস্ত মানুষ সমাজে বসবাস করে, সামাজিক অনুশাসন মেনে চলে এবং সামাজিক রীতিনীতির ভিত্তিতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, শুধুমাত্র সেইসব মানুষের আচরণ নিয়েই আলোচনা করে নীতিবিজ্ঞান এবং সেগলির নৈতিক বিচার করে। সমাজবহির্ভূত কোনো ব্যক্তির আচার-আচরণ নিয়ে তাই নীতিবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয় না। কারণ, নৈতিকতার বিষয়টি সামাজিক মানুষের মধ্যেই পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত। সুতরাং বলা যায় যে, নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতি হল সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচার-আচরণ নিয়ে আলোচনা করা এবং সুেগলি সম্পর্কেই নৈতিক বিচার করা। সেকারণেই বলা যায় যে, নির্জন দ্বীপের অধিবাসী রবিনসন ক্রুশো এবং আলেকজান্ডার সেলক্লিকদের আচার-আচরণের নৈতিক বিচার সম্ভব নয়। নৈতিকতার বিষয়কে তাই নীতিবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কেনা একপ্রকার সামাজিক উদ্যোগ (Social enterprise)-রূপে অভিহিত করেছেন। অ্যারিস্টট্লও তাই যথার্থই বলেছেন, যে মানুষ সমাজে বসবাস করে না, সে অবশ্যই পশু অথবা দেবতা।
আদর্শমূলক নৈতিক মাপকাঠিতে নীতিবিজ্ঞান
নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতিতে এ কথা বলা যায় যে, নীতিবিজ্ঞান এমনই এক আদর্শমূলক বিজ্ঞান যা সমাজস্থ মানুষের আচরণগুলিকে কতকগুলি নৈতিক আদর্শমূলক মাপকাঠির ভিত্তিতে বিচারবিবেচনা করে। নীতিবিজ্ঞানের এই সমস্ত মাপকাঠিগুলি হল ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি। এই সমস্ত মাপকাঠিগুলিকে নীতিবিজ্ঞান আদর্শগত মাপকাঠি হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং এগুলির ভিত্তিতেই সামাজিক মানুষের আচার-আচরণের বিচার করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোনো মানুষের কাজকে ন্যায় বা অন্যায়, উচিত বা অনুচিত হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং সেগুলিকে গ্রহণ অথবা বর্জন করা হয়। সুতরাং বলা যায় যে, নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপে কতকগুলি নৈতিক প্রত্যয়কে মাপকাঠি হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে এবং সেগুলির সাহায্যেই নৈতিক বিচার করা হয়।