নৈতিকতার প্রকৃতি কী তা সংক্ষেপে উল্লেখ করো

নৈতিকতার প্রকৃতি কী তা সংক্ষেপে উল্লেখ করো
নৈতিকতার প্রকৃতি কী তা সংক্ষেপে উল্লেখ করো।

নৈতিকতার প্রকৃতি

নীতিবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয় হল নৈতিকতা (morality)। আমরা প্রাথমিকভাবে নীতিবিজ্ঞানের প্রকৃতির সঙ্গে নৈতিকতার প্রকৃতিকে এক করে দেখি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরূপ বিষয়টি ঠিক নয়। নীতিবিজ্ঞান নৈতিকতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করে ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞান হিসেবে নীতিবিজ্ঞানের প্রকৃতিকে কখনোই নৈতিকতার প্রকৃতির সঙ্গে এক করে দেখা উচিত নয়। বিজ্ঞান হিসেবে নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ কী তা তার প্রকৃতি থেকেই জানা যায়। আর নৈতিকতার বিষয়টি ঠিক কী বোঝাতে চায়, তা তার প্রকৃতি থেকেই বোঝা যায়। নীতিবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কেনা তাঁর ‘Ethics’ গ্রন্থে নৈতিকতার প্রকৃতিটিকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। নৈতিকতার প্রকৃতি বা স্বরূপকে আমরা নিম্নোক্তভাবে উপস্থাপন করতে পারি।

নৈতিকতার প্রকৃতিতে সঞ্চরণশীলতা

নীতিতত্ত্বের আলোচনায় দেখা যায় যে, মানুষের সেই জীবনই কাম্য যা নৈতিকতাসম্পন্নরূপে বিবেচিত। এই নৈতিকতার বিষয়টিই হল নীতিতত্ত্বের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই নৈতিকতা ব্যক্তির মাধ্যমে প্রকাশিত হয় ঠিকই, কিন্তু তাকে কখনোই ব্যক্তিকেন্দ্রিকরূপে গণ্য করা যায় না। কারণ, ব্যক্তিবিশেষের নৈতিকতার সঙ্গে অপর ব্যক্তিদের স্বার্থও যুক্ত থাকে। আবার একজন ব্যক্তির নৈতিকতা অপর ব্যক্তিদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। যেমন- যখন কোনো ব্যাক্তি বলেন আমার চুরি করা উচিত নয়, তখন নৈতিকতার এরূপ ধারণাটি শুধুমাত্র সেই ব্যক্তির মধ্যেই সীমায়িত না থেকে, তা অপর ব্যক্তিদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।

নৈতিকতার স্বরূপে সর্বজনীনতা

নৈতিকতা সম্পর্কিত যে-সমস্ত বিধি বা নিয়ম দেখা যায়, সেগুলি কখনোই ব্যক্তিকেন্দ্রিকরূপে গণ্য নয়, সেগুলি হল সর্বজনীন। কান্টের নৈতিক ধারণা নৈতিকতার এরূপ স্বরূপ বা প্রকৃতিকেই উদ্ভাসিত করে। সর্বজনীন নৈতিক নিয়মের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করাই হল নৈতিকতার ধর্ম। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, মিথ্যা কথা বলা উচিত নয়। এরূপ নৈতিক নিয়মটিকে শুধুমাত্র কোনো পরিস্থিতিকে বিচার করে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। এরূপ নৈতিক নিয়মটি যে-কোনো পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সমানভাবে প্রযোজ্য। এর কোনো ব্যতিক্রম থাকা উচিত নয়। স্থান, কাল বা পাত্রভেদের সঙ্গে সঙ্গে এরূপ নীতিবাক্যটির অন্তঃস্থিত নৈতিকতা বোধের কোনো পরিবর্তন হওয়া উচিত নয়। সেকারণেই বলা যায় যে, নৈতিকতার নিয়মে সর্বজনীনতার ভাব প্রকটিত।

নৈতিকতার স্বরূপে চরম ও পরম মূল্য

নৈতিকতার প্রকাশক রূপে নৈতিক নিয়মগুলি চরম ও পরম মূল্যবানরূপে গণ্য। কারণ, এই সমস্ত নৈতিক নীতি বা বিধিগুলিকে আমাদের নৈতিক জীবনের পথপ্রদর্শকরূপে গণ্য করা হয়। আমরা যখন কেনো কাজ করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হই এবং একটি স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হই, তখন এই সমস্ত নৈতিক বিধিগুলিই আমাদের পথনির্দেশ করে। সেকারণেই এই সমস্ত বিধিগুলিকে নৈতিকতার আলোক দিশারিরূপে গণ্য করা হয়। এই সমস্ত বিধি বা নিয়মগুলি স্বতঃভাবেই সৎ ও মঙ্গলময়। মানবসমাজের মঙ্গলসাধনের উদ্দেশ্যেই এই সমস্ত বিধিগুলিকে রচনা করা হয়েছে। এগুলি তাই চরমভাবে মূল্যবান। নৈতিকতাকে তাই চরম ও পরম মূল্যের প্রকাশরূপে গণ্য করা হয়।

নৈতিকতার স্বরূপে বুদ্ধিসঞ্জাত যুক্তি

নীতিতত্ত্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নৈতিকতা কোনো কাল্পনিক বা অবাস্তব বিষয় নয়। এ হল মানুষের বুদ্ধিসঞ্জাত ও যুক্তিনির্ভর বিষয়। কারণ, যুক্তিহীনতার বেদিমূলে কোনো সর্বজনীন নৈতিকতা বা নৈতিক নিয়ম গড়ে উঠতে পারে না। নৈতিকতার ক্ষেত্রে তাই নিছক কোনো ব্যক্তিগত আবেগ বা অনুভূতি থাকতে পারে না। নৈতিকতার এরূপ প্রকৃতির ওপরই সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন প্রখ্যাত নীতিদার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। তিনি যুক্তির ওপর নির্ভর করেই নৈতিক নিয়মগুলির ক্ষেত্রে সর্বজনীনতার কথা বলেছেন। তিনি তাই বলেন, সর্বজনীন নৈতিক নিয়মগুলি সবার ক্ষেত্রে সমানভাবেই পালনীয়। এগুলির ক্ষেত্রে তাই কোনোরকম ব্যতিক্রম থাকা উচিত নয়। কান্ট তাই বলেন, ‘বুদ্ধিদীপ্ত সৎ ইচ্ছা সবসময়ই বিনা শর্তে সৎ’।

নৈতিকতার স্বরূপে বিবেকের অনুশাসন

নৈতিকতা হল মানুষের বিবেকের অনুশাসন বা নির্দেশ। বিবেকবর্জিত কোনো ব্যক্তির তাই কোনো নৈতিকতাই থাকতে পারে না। একমাত্র বিবেকের দ্বারা তাড়িত হয়েই মানুষ নৈতিকতাসম্পন্ন কাজকর্ম করে থাকে। বিবেককেই তাই নৈতিকতার উৎসরূপে গণ্য করা হয়। এই বিবেকের দ্বারা তাড়িত হয়েই মানুষ কর্তব্যের জন্য কর্তব্য (Duty for duty) করে, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। সেকারণেই বিবেকবর্জিত ব্যক্তিকে পশুর সমতুল্য ভাবা হয়। পশুর যেমন কোনো নৈতিকতা থাকে না, তেমনই বিবেকবর্জিত মানুষেরও কোনো নৈতিকতা থাকতে পারে না। নৈতিকতাকে তাই বলা হয় বিবেকের নির্দেশ বা অনুশাসন। সেকারণেই বলা যায়, যে-কাজ বিবেকনির্দেশিত সেই কাজই নৈতিকতাসম্পন্ন ও যথোচিতরূপে গণ্য।

Leave a Comment