বিচিত্র পর্যায়ের গান
প্রবন্ধে ব্যবহৃত গানটি রবীন্দ্রসংগীতের ‘বিচিত্র’ পর্যায়ের গান। এই পর্যায়ের গানগুলি তাদের অদ্ভুত বৈচিত্র্যের গুণে আর অন্য কোনো পর্যায়ে স্থান পায়নি-স্থান পেয়েছে ‘বিচিত্র’ পর্যায়তেই।
‘পূজা’ পর্যায় কিংবা ‘প্রেম’ পর্যায়ের গানে যেমন, রবীন্দ্রনাথ স্বর্গ কিংবা মর্ত্য সর্বত্রই পাড়ি দিয়েছেন, তেমনই তাঁর গানের ভাষায় আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে জীবনদেবতা কিংবা প্রিয়তমের সন্ধান করেছেন। একইভাবে এই গানটিতেও রবীন্দ্রনাথ স্বর্গ রচনা করলেও পরমুহূর্তেই তাঁর মনে হয়েছে যে, তাঁর পরমারাধ্য জীবনদেবতা স্বর্গসভার মহাঙ্গনে নয়; তিনি বিরাজ করছেন নিদ্রাবিহীন নৈসর্গিক পৃথিবীতেই। তাই রবীন্দ্রনাথ কালের সাগর পাড়ি দিয়ে মাটির ধরাতলেই নেমে এসেছেন। এই গানটিতে পূজা পর্যায়ের আধ্যাত্মিকতা নেই, দেবতাকে প্রিয় করার আশ্বাসও নেই। আবার সর্বতোভাবে মানবধর্মের দিকটিও নেই। বিচিত্র পর্যায়ের এই গানটিতে নিহিত আছে ধরাতলের বাস্তব সৌন্দর্য, কল্পলোকের আশা ও সীমার মধ্যেই অসীমকে খুঁজে পাওয়ার সত্য।
মূলভাব
গানটির মর্মকথা হল-বিনিদ্র রাতে কবি তারাভরা উজ্জ্বল আলোকময় আকাশে চেয়ে কল্পনা করেন, ওখানে আলোকিত স্বর্গসভা আছে। সেখানে একদা সে কোন্ যুগে তিনি যেন নিমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু সেখানে তাঁর ভালো লাগেনি। তাই মহাকালের সাগর পেরিয়ে মর্ত্যে এসেছেন। এখানকার শ্যামল মাটি, জলে-স্থলে মন্দমধুর কানাকানি, ঘাসে ঘাসে রঙিন ফুল, আলো-আঁধারি বনপথ তাঁর ভালো লেগেছে। স্বর্গের বৈভব নয়, মর্ত্যের প্রাণতা; দেবতা নয়, মানুষই কবির কাছে শ্রেয়। তিনি মানবজন্ম লাভ করে ধন্য। এই গানে স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যপ্রীতি, মানবপ্রীতি, প্রকৃতির সৌন্দর্যচেতনা প্রকাশ পেয়েছে।
কবির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শ্রোতারাও এই কল্পরাজ্যে পাড়ি দেন আর স্বর্গের নানা মহিমা শোনার জন্য তারা প্রস্তুত হতে-না-হতেই কবি তাদের নামিয়ে আনেন বাস্তবের মাটিতে, তারা টের পান এই মর্ত্যলোক অনেক বেশি সত্য, শান্তিময়, স্বস্তির। মর্ত্যলোকে মানুষকে দেবতার চেয়ে মহত্তররূপে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সর্বোপরি, রবীন্দ্রগানের প্রতিটি কথা শ্রোতার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের এই অলৌকিক ক্ষমতার স্বাক্ষর বহন করে এই গানটি।