পারস্যের ‘স্যাট্রাপ’ বা ক্ষত্রপদের সম্পর্কে বিবরণ দাও
অথবা, পারস্যের স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপদের সম্পর্কে আলোকপাত করো

ভূমিকা
পৃথিবীর অন্যতম একটি প্রাচীন ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য হল পারস্যের আকিমেনীয় সাম্রাজ্য (৫৫০-৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে)। এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস বা সাইরাস দ্য গ্রেট। সম্রাট সাইরাস এবং তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি প্রথম দারিউসের নেতৃত্বেই এই বিশাল পারসিক সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে তাঁরা এই সুবিশাল সাম্রাজ্যকে কতকগুলি বৃহৎ ও ক্ষুদ্র প্রদেশ বা অঞ্চলে ভাগ করেন। এই প্রদেশ বা অঞ্চলগুলি পরিচিত ছিল স্যাট্রাপি (Satrapy) নামে এবং এই প্রদেশের শাসনকর্তাকে বলা হত ‘স্যাট্রাপ’ (Satrap) বা ক্ষত্রপ। হেরোডোটাসের রচনা এবং আকিমেনীয় সম্রাটদের বিভিন্ন শিলালিপি থেকে স্যাট্রাপদের সম্পর্কে নানা মূল্যবান তথ্য জানা যায়।
অর্থ
‘স্যাট্রাপ’ শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘স্যাট্রাপিস’ (Satrapes) বা ‘স্যাট্রাপিয়া’ থেকে। এই ‘স্যাট্রাপ’ শব্দটি প্রাচীন পারসিক ভাষায় ‘ক্ষত্রপভ’ বা ক্ষত্রপ নামে উল্লিখিত হয়েছে, যার অর্থ ‘প্রদেশের রক্ষাকর্তা’ (Protector of the province)। সংস্কৃতেও ক্ষত্রপ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এককথায়, প্রাচীন আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের প্রদেশের শাসনকর্তা স্যাট্রাপ নামে পরিচিত ছিলেন। আর স্যাট্রাপরা যে প্রদেশ বা অঞ্চল শাসন করতেন, সেই প্রদেশগুলি স্যাট্রাপি নামে পরিচিত ছিল।
উত্থান
আনুমানিক ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেটের আমলে আকিমেনীয় সাম্রাজ্যে স্যাট্রাপি বা প্রদেশগুলির উত্থান ও বিকাশ ঘটে। শাসনকার্যের সুবিধার্থে এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি সাম্রাজ্যকে ২৬টি স্যাট্রাপি বা প্রদেশে ভাগ করেন। প্রদেশের শাসক হিসেবে স্যাট্রাপদের উত্থান হয়। পরবর্তীকালে সম্রাট প্রথম দারিউস এই স্যাট্রাপিগুলিকে সুসংগঠিত করেন। তাঁর আমলে বড় স্যাট্রাপি বা প্রদেশগুলিকে আবার ছোটো প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। বেহিস্তান শিলালিপি থেকে জানা যায় যে তাঁর সময়ে প্রদেশগুলির সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ৩৬টি।
সম্রাট ও স্যাট্রাপের সম্পর্ক
(1) নিয়োগ ও পদচ্যুতি: সম্রাটরা প্রদেশের গভর্নর বা শাসনকর্তা হিসেবে স্যাট্রাপদের নিয়োগ করতেন। মূলত রাজপরিবারের সদস্য কিংবা অভিজাত পরিবারের মধ্যে থেকে এঁদের নিয়োগ করা হত। স্যাট্রাপরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সম্রাট তাঁদের সতর্ক এমনকি পদচ্যুতও করতেন।
(2) আনুগত্য : যেহেতু সম্রাটই স্যাট্রাপদের নিয়োগ করতেন, স্বভাবতই সম্রাটের সঙ্গে তাঁদের আনুগত্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
(3) দায়বদ্ধতা: স্যাট্রাপরা ছিলেন মূলত সম্রাটের প্রতিনিধি। তাই সকল কাজকর্মের জন্য তাঁরা সম্রাটের কাছেই দায়বদ্ধ থাকতেন।
(4) নজরদারি : স্যাট্রাপরা যাতে ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে না পারে, তার জন্য সম্রাট তাঁদের কড়া নজরে রাখতেন। এই উদ্দেশ্যে সম্রাট ‘রাজার নয়ন’ (Eyes of the king) নামক এক শ্রেণির পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেন। এঁরা প্রদেশগুলিতে ঘুরে রাজাকে নানা খবরাখবর দিতেন। সম্রাট প্রথম দারিউসের আমল থেকে তাঁদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।
স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপদের কার্যাবলি
স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপরা ছিলেন প্রদেশের শাসনের সর্বময় কর্তা। প্রদেশের শাসনকর্তা হিসেবে তাই তাঁকে নানা দায়দায়িত্ব পালন করতে হত। যথা-
(1) করসংগ্রহ: স্যাট্রাপদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল তাঁর শাসনাধীন অঞ্চল থেকে করসংগ্রহ করা এবং তা রাজার কোশাগারে প্রেরণ করা।
(2) শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা: কর আদায়ের পাশাপাশি স্যাট্রাপদের তাঁর প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হত।
(3) বিচারকার্য পরিচালনা: স্যাট্রাপরা ছিলেন প্রদেশগুলির বিচারব্যবস্থার সর্বেসর্বা। তাই কর আদায় এবং শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি তাঁকে বিচারের তত্ত্বাবধানও করতে হত।
(4) সামরিক দায়িত্ব: সৈন্যবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণসহ তাঁদের নানা সামরিক দায়দায়িত্ব পালন করতে হত।
(5) অন্যান্য দায়িত্ব : উক্ত দায়িত্বগুলি সামলানোর পাশাপাশি স্যাট্রাপদের আরও তাঁদের অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে হত। যেমন-আঞ্চলিক বিদ্রোহ দমন, স্থানীয় স্তরে আমলাদের নিয়োগ, বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধে অংশগ্রহণ ইত্যাদি।
মূল্যায়ন
সবশেষে বলা যায়, স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপরা ছিলেন প্রাদেশিক শাসনের মূলস্তম্ভ। কিন্তু পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় শাসকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন হয়ে ওঠেন। এমনকি তাঁরা অনেক সময়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করতেন। ফলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, তাঁদের দক্ষতার ওপরেই সাম্রাজ্যের ভালোমন্দ নির্ভর করত।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর