পালসপোলিও রচনা

বর্তমানের শিশু আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ আশা ভরসা। তারা যদি সুস্থ-সবল না হয় তাহলে ভবিষ্যতে সমগ্র দেশ-সমগ্র জাতি দুর্বল হয়ে পড়বে, পঙ্গু হয়ে যাবে দেশের অগ্রগতি। শিশুকে সুস্থ ও সবল রাখতে হলে যেমন প্রয়োজন পুষ্টিকর আহার তেমনি দরকার তাকে রোগ মুক্ত রাখা। প্রায় দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসনও শোষণের ফলে দেশের একটি বিরাট অংশের মানুষ এখনও রয়েছে দারিদ্র সীমার নীচে। তারা নানা অসুখে আক্রান্ত। পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলির অন্যতম আমাদের দেশ। সরকারও চুপ করে বসে নাই। গুটিবসন্ত, পোলিওপ্রভৃতি মারাত্মক রোগকে দেশ থেকে তথা সমগ্র পৃথিবী থেকে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশও নির্মূল করতে বদ্ধ পরিকর। তাই প্রতিটি শিশুকে পালসপোলিও টিকা দানের ব্যবস্থা সরকারী ভাবে করা হয়েছে।

পোলিও রোগের কারণ

পোলিও একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। জল বা খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। প্রথমে প্রবেশ করে খাদ্যনালীতে। সেখান থেকে স্নায়ুতন্ত্রে প্রবেশ করলে রোগের ক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। শরীরের অঙ্গ শিথিল হতে থাকে। একে বলা হয় এ্যাকিউট ফ্লাসিড প্যারালিসিস বা সংক্ষেপে (AFP)

পোলিও টিকার আবিষ্কার

পোলিও রোগ প্রতিরোধে টিকার অত্যন্ত কগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। জোনাস শালক নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবাণুতত্ব বিভাগে ইনফ্লুয়েজ্ঞা বিষয়ে গবেষণা করার সময় পোলিও আক্রান্ত একটি শিশুর প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়লে তিনি পোলিও রোগ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। অবশেষে তিনি পরলেন জয়ের মুকুট। কয়েক বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে পোলিও রোগের প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার করেন তিনি। প্রথম এই প্রতিষেধক টিকা নিজে নিলেন। এরপরে নিজের শরীরে পোলিও ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখলেন যে পোলিও ভাইরাস তাঁর শরীরে কোন ক্রিয়া করতে পারল না। ডাঃ জোনাস শালক ছিলেন এমন এক বক্তি যিনি মানব কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। আবিষ্কৃত পোলিও টিকা পেটেন্ট করে বহু অর্থ উপার্জনের কথা না ভেবে তাঁর আবিষ্কারের কথা জগৎবাসীকে জানিয়ে দিলেন। সারা পৃথিবীতে ঘটল এক যুগান্তকারী ঘটনা। সমস্ত দেশ এগিয়ে এল পোলিও মুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে। ১৯৫৭ সালে ডাঃ সাবিন পোলিও ভ্যাকসিনেশন তৈরি করে পোলিও প্রয়োগের ব্যবস্থার উন্নতি ঘটালেন। জীবিত ভাইরাসকে নির্বিষ করে শরীরে প্রয়োগ করলে তা প্রতিরোধ ক্ষমতাসৃষ্টি করে। পোলিও ভ্যাকসিন খাওয়ালে শিশুর শরীরে যদি ভাইরাস প্রবেশ করে তা মলের মাধ্যমে নির্বিষ হয়ে বেরিয়ে যায়।

পোলিও ভ্যাকসিনের প্রয়োগ

পোলিও ভাইরাস তিন ধরনের হয়-টাইপ-1,11,111, যেকোন এক জাতের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলেই পোলিও হয়। পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে শিশুদের মুখে দু’ফোঁটা করে টিকা খাওয়ানো হয়। তাতে তিন ধরনের ভাইরাস প্রতিষেধক থাকে। এখন সারা পৃথিবীতে পোলিও টিকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভারতেও জাতীয় টিকাকরণ দিবস (N/D) পালিত হচ্ছে। এই ব্যবস্থার ফলে টাইপ 11 পোলিও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। টাইপ 1 এবং টাইপ 111 পোলিও এখনও যে কয়েকটি দেশে আছে,ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৫ সালের আগে জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচীর মাধ্যমে একজন শিশুকে তিন থেকে পাঁচবার রুটিন মাফিক টিকা খাইয়েও প্রতিবছর প্রায় ৩৫,০০০ শিশু পোলিও রোগে আক্রান্ত হত। ১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুসারে রুটিন টিকাকরণ কর্মসূচীতে পোলিও সহ মোট ছ’রকম রোগের বিরুদ্ধে যেমন নির্দিষ্ট বয়সের ব্যবধানে নানারকম প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল তা তো চলছেই, তাঁর সাথে পালস্ পোলিও -এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতীয় টিকাকরণ দিবসে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১৭ কোটি শিশুকে দু’ফোঁটা করে টিকা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে ও সরকারী বেসরকারি সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে হঠাৎ কোনো শিশুর অঙ্গশৈথিল্য দেখা দিলে (AFP) বা অ্যাকিউট ফ্ল্যাসিড প্যারালিসিস হলে জেলা প্রশাসন, জেলা স্বাস্থ্যদপ্তর, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার আধিকারিককে খবর দিতে হবে। খবর পেলেই স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মী এসে পায়খানার নমুনা সংগ্রহ করে বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করে পরীক্ষার জন্য অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দেবেন। পরীক্ষার পরে জানা যাবে অ্যাকিউট ফ্ল্যাসিড প্যারালিসিস হয়েছে না অন্য কোন কারণে পোলিও ভাইরাস-আক্রমণ করেছে। পোলিও ভাইরাস মলের মাধ্যমে শরীরের বাইরে আসে, খাদ্যনালী দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে বংশ বৃদ্ধি ও পুষ্টি হয়। পোলিও প্রতিষেধক খাওয়ালে সেই প্রতিষেধক পোলিও ভাইরাস ও মলের মাধ্যমে শরীরের বাইরে আসে এবং পরিবেশের সাথে মিশে পোলিও ভাইরাসের মুখোমুখি হয় এবং সেই ভাইরাস ধবংস হয়।

পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূল কি হয়েছে

জানা গেছে অনুসন্ধান থেকে নবীন জনসংখ্যার গড়ে প্রতিবছর একলক্ষের মধ্যে একজনের অঙ্গ শৈথিল্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ২০০৫ সালে ভারতে এ.এফ.পি. রোগীর সংখ্যা ২৭,০৫০ এবং তার মধ্যে নির্ণীত পোলিও রোগীর সংখ্যা ৬৬ জন। আবার বছরের প্রথমের দিকের তুলনায় দ্বিতীয়াংশে পোলিও রোগীর সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।

উপসংহার

বাংলাদেশ, সোমালিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইয়েমেনের মতো দেশে পোলিও রোগীর সংখ্যা একেবারেই কমে গিয়ে দীর্ঘবছর পরে আবার প্রার্দুভাব দেখা যাচ্ছে। শিশুর পিতামাতাকে ও সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে পোলিও সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে তা না হলে পৃথিবীকে পোলিও মুক্ত করা সম্ভব নয়। পোলিও ভ্যাকসিনের কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। এখন পর্যন্ত ১৪৫টি দেশ থেকে পোলিও নির্মূল হয়েছে।

Leave a Comment