পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু

পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু
পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু

পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁইমাচা’ গল্পটি একটি সামাজিক গল্প। গ্রামের দরিদ্র ব্রাহ্মণ সহায়হরি চাটুজ্যে, তাঁর স্ত্রী ও তিন কন্যা ক্ষেন্তি, পুঁটি ও রাধাকে নিয়ে বসবাস করেন। তাঁর বড়ো মেয়ে ক্ষেন্তিকে নিয়ে গল্পটি আবর্তিত হয়েছে। ক্ষেন্তি হল ভোজনরসিক এবং অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। সারাদিন সে আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। কারো গাছ, কারো বাগান, কারো বা পুকুর থেকে তুলে আনে পুঁইডাঁটা, মেটে আলু বা চিংড়ি। তার এই কাজে সঙ্গী থাকে দুই বোন পুঁটি ও রাধী, কখনোবা বাবা সহায়হরি।

চোদ্দ-পনেরো বছরের এই সাদাসিধে, সহজসরল মেয়েটাকে বাবা সহায়হরি একটু বেশিই ভালোবাসেন। তাই অযোগ্য পাত্রের সঙ্গে ঠিক হওয়া বিয়ে ভেঙে দিতে তিনি এক মুহূর্তও দেরি করেন না। কিন্তু এর ফলে সমাজের গণ্যমান্য মাতব্বর শ্রেণির ব্যক্তিরা অত্যন্ত বিরক্ত হন এবং সহায়হরির পরিবারকে একঘরে করে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। স্ত্রী অন্নপূর্ণার কানে এসে পৌঁছায় এই সংবাদ। আর তখন তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন এবং সদাসর্বদা খাওয়ার প্রতি যার পরম লোভ সেই ক্ষেন্তিকে নিয়ে নানান চিন্তায় থাকেন।

ক্ষেন্তি এসব নিয়ে একেবারেই ভাবে না। এক গাদা পাকা পুঁইশাক ও শালাপাতায় লুকানো কুচো চিংড়ি নিয়ে আসে। এই ঘটনায় অন্নপূর্ণাদেবী অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হন। পুঁটিকে সব ফেলে দিয়ে আসতে বলেন। আবার, পরবর্তী সময়ে মায়ের মন কেঁদে ওঠে এবং তিনি চুপিচুপি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু পুঁইডাটা তুলে এনে চিংড়ি দিয়ে রান্না করে মেয়েকে খেতে দেন। মেয়ের মুখের পরিতৃপ্তি দেখে মায়ের মন আনন্দে ভরে ওঠে।

এরপরই একদিন অন্নপূর্ণা দেবী দেখেন ভাঙা পাঁচিলের পাশের জমিতে কনকনে শীতের মধ্যে ক্ষেন্তি একটা পুঁইচারা লাগাচ্ছে। অসময়ে লাগানো চারায় রোজ জল ঢেলে গাছটির যত্ন করে পুঁটি। পৌষ-সংক্রান্তিতে অন্নপূর্ণা পিঠে বানিয়ে দেন মেয়েদের। দরিদ্রের সংসারেও মায়ের চেষ্টার অন্ত নেই মেয়েদের মুখে হাসি ফোটানোর। ভোজনবিলাসী ক্ষেন্তি একাই আঠারো-উনিশটা পিঠে খেয়ে ফেলে। এইরকম একটি সরল সাদাসিদে মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবন ও বিবাহিত জীবন নিয়ে বাবা-মা বেশ চিন্তায় থাকেন।

এরপর বৈশাখ মাসের প্রথমেই সহায়হরির দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের ঘটকালিতে এক চল্লিশ বছর বয়সি বুড়ো পাত্রের সঙ্গে ক্ষেন্তির বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু সেই বিবাহ সুখের হল না। মাত্র আড়াইশো টাকা বাকি থাকায় তারা ক্ষেন্তিকে বাপের বাড়িতে পাঠালো না। ফাল্গুন মাসে ক্ষেন্তির বসন্ত হল। তার গা থেকে সব গয়না খুলে নিয়ে তাকে দিয়ে এল টালাতে বসবাসকারী সহায়হরির এক দূরসম্পর্কীয় বোনের বাড়ি। কিন্তু বাপের বাড়ি পাঠালো না। সেখানেই অযত্নে অবহেলায় মৃত্যু হল ক্ষেন্তির।

সামাজিক এই অবিচার, অত্যাচার ও শোষণ নাড়িয়ে দিয়ে গেল সহায়হরির গোটা পরিবারকে। তবুও কালের নিয়মে চলতে লাগল তাদের জীবন। অন্নপূর্ণা আবার পিঠে বানালেন। পুঁটি ও রাধাকে খেতে দিলেন। তার মন হু হু করে উঠল ক্ষেন্তির জন্য। ক্ষেন্তি আজ আর জীবিত নেই। কিন্তু ক্ষেন্তির লাগানো পুঁইচারাটি বেড়ে উঠেছে। কচি কচি পাতা ধরেছে তাতে। মা ও বোনেরা তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ক্ষেন্তি বেঁচে রয়েছে ওই পুইগাছটির মধ্যে। তকতকে লাবণ্যময় পুঁইগাছটি বেড়ে উঠছে আপন খেয়ালে। ক্ষেন্তিও যদি আজ বেঁচে থাকত, তার কৈশোর-যৌবনও লাবণ্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত। কিন্তু ক্ষেন্তি আজ শুধু নধর পরিপুষ্ট পুঁইগাছের স্মৃতিচিহ্নের মধ্যেই জীবন্ত হয়ে আছে।

আরও পড়ুন – বিড়াল প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ও নামকরণ

Leave a Comment