প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ- চার্বাকরা এ কথা কেন বলেছেন

 

প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ- চার্বাকরা এ কথা কেন বলেছেন
প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ- চার্বাকরা এ কথা কেন বলেছেন

প্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষ

ভূমিকা: চার্বাক দর্শন তত্ত্বের মূলভিত্তিই হল তাদের জ্ঞানতত্ত্ব। এই জ্ঞানতত্ত্বের মূল বিষয়ই হল প্রমাণ। যথার্থ জ্ঞানের উৎসকেই বলা হয় প্রমাণ। ভারতীয় দর্শনে মোট নয়টি প্রমাণকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে মুখ্য প্রমাণ হল তিনটি প্রত্যক্ষ, অনুমান এবং শব্দ। এই তিনটি প্রমাণের মধ্যে জড়বাদী চার্বাকগণ শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ বা যথার্থ জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন।

প্রত্যক্ষের ধারণা: ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অর্থ বা বিষয়ের যে সংযোগ বা সন্নিকর্ষ, তাকেই বলা হয় প্রত্যক্ষ। এই প্রত্যক্ষ প্রমাণ থেকে উৎপন্ন জ্ঞানকেই বলা হয় প্রত্যক্ষ-প্রমা। চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষের ওপরই সমস্ত প্রকার জ্ঞান নির্ভরশীল বলে | একে বলা হয় প্রমাণ-শ্রেষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ প্রমাণ।

প্রত্যক্ষের বিভাগ:
চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক-এই পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমাদের বাহ্যবস্তুর প্রত্যক্ষ হয়। আর সুখ, দুঃখ, অনুভূতি প্রভৃতি মানস অবস্থার জ্ঞানকে বলা হয় মানস প্রত্যক্ষ। আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় নিজ নিজ বিষয়ের সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্বন্ধযুক্ত এবং এর ফলেই প্রত্যক্ষ-প্রমা জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয়। এই ধরনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার সংশয় থাকে না বলেই প্রত্যক্ষকে সার্থক প্রমাণরূপে গণ্য করা হয়।

প্রমাণের শর্ত

চার্বাক মতে যা প্রমাণরূপে গণ্য, তাকে হতে হবে-

[1] যথার্থ অনুভব: এর অর্থ হল-যে বিষয়টি যা, তাকে ঠিক সেই ভাবেই জানা। যেমন ঘটকে ঘটরূপে জানা।

[2] বিপর্যয় শূন্য: এর অর্থ হল-যথার্থ জ্ঞান। অযথার্থ জ্ঞানকে বলা হয় বিপর্যয়। যে বস্তুতে যে ধর্মের অভাব আছে তাকে ঠিক সেই ধর্মীরূপে জানাই হল বিপর্যয়। যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম। প্রমাণকে এরূপ বিপর্যয়যুক্ত হলে হবে না। তাকে হতে হবে বিপর্যয় শূন্য। সাবতী আপ

[3] সন্দেহাতীত: প্রমাণকে সন্দেহযুক্ত হলে হবে না। প্রমাণকে হতে হবে সন্দেহশূন্য বা সন্দেহের অতীত। যেমন কোনো কিছুকে দেখে সেটা স্থানু (গাছের কাণ্ড) না মানুষ-এরূপ সংশয় বা সন্দেহ না থাকা।

[4] অবাধিত: অবাধিত শব্দটির অর্থ হল বাধা না পাওয়া। অর্থাৎ বিরুদ্ধ কোনো বিষয় দ্বারা প্রমাণের ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া চলবে না।

[5] অনধিগত: অনধিগত শব্দের অর্থ হল আগে থেকে না জানা। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করার আগেই বিষয়টিকে না জানা। শুধুমাত্র প্রত্যক্ষের পরই তাকে নতুনভাবে জানতে হবে।

চার্বাক মতে, শুধুমাত্র প্রত্যক্ষই যথার্থ বা প্রমা জ্ঞানের এই সমস্ত শর্তগুলিকে পূরণ করতে সমর্থ। কারণ, প্রত্যক্ষের জ্ঞানই কেবলমাত্র সন্দেহাতীত, স্পষ্ট ও অভ্রান্তরূপে গণ্য। প্রত্যক্ষই তাই যথার্থ অনুভবের সৃষ্টি করতে পারে। তাই প্রত্যক্ষই প্রমা জ্ঞানের একমাত্র উৎস বা প্রমাণ। এই প্রত্যক্ষের ওপরই অপরাপর প্রমাণগুলি নির্ভরশীল।

অনুমান এবং শব্দ প্রভৃতি প্রমাণ সন্দেহাতীত, স্পষ্ট ও অভ্রান্তরূপে গণ্য নয়। কারণ, এগুলি অপ্রত্যক্ষযোগ্য বিষয়ের জ্ঞান দান করে। ফলে, তা ভ্রান্ত ও সন্দেহজনকরূপে গণ্য। সেজন্যই চার্বাকগণ দাবি করেন যে, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ।

Leave a Comment