প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করো

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করো
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করো

ভূমিকা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল বিভিন্ন কারণের পরিণতি। সংকট ও সংঘাতের কালো পর্দায় ইউরোপ আবৃত হয়েছিল। লেনিন পরিস্থিতিকে ‘বারুদের স্তূপ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলি হল-

[১] ইউরোপীয় শক্তিবর্গের ঔপনিবেশিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা : শিল্পবিপ্লবের পরে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পোর্তুগাল, স্পেন প্রভৃতি দেশ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপনের ব্যাপারে বেশ কিছুটা এগিয়ে ছিল। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের আমলে জার্মানিতে শিল্পবিপ্লব ঘটলে উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রি ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য জার্মানি এবং ইটালি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের পথে পা বাড়ালে সর্বত্রই এই দুটি দেশ প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ফলে জার্মানি ও ইটালির অতৃপ্ত ঔপনিবেশিক আকাঙ্ক্ষা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য করে তোলে।

[২] ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা: উপনিবেশ বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় রাজনীতি জটিল আকার লাভ করে এবং প্রত্যেকটি শিল্পোন্নত দেশ ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। এগুলি হল—এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের ঔপনিবেশিক দ্বন্দু, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে বাণিজ্যিক দ্বন্দু। এই দ্বন্দুগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।

[৩]  জার্মানির বিশ্বরাজনীতি ও ব্রিটেনের আশঙ্কা : জার্মানির সাম্রাজ্য বিস্তারের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য জার্মানি যুদ্ধকেই একমাত্র অস্ত্র হিসেবে দেখতে থাকে এবং স্থল ও নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করে। জার্মানির এই নীতিতে ব্রিটেনের আশঙ্কা হয় যে, জার্মানি ব্রিটিশ উপনিবেশগুলি গ্রাস করতে চায়। ব্রিটেনের এই আশঙ্কাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে।

[৪] ইঙ্গ-জার্মান নৌ-প্রতিদ্বন্দ্বিতা: জার্মানি নৌশক্তি বৃদ্ধি করলে উত্তর সাগর ও ইংলিশ চ্যানেলের ব্রিটিশ উপকূল আক্রান্ত হবে বলে আশঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারও তাদের নৌশক্তি বৃদ্ধি করে। এইভাবে ইঙ্গ-জার্মান নৌ-প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে।

[৫] ইটালি ও ফ্রান্সের মধ্যে ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব : ফ্রান্সের উত্তর আফ্রিকার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে তার ন্যায্য অধিকার আছে বলে ইটালি মনে করতো। এর ফলে উভয় দেশের মধ্যে প্রবল বিরোধের সৃষ্টি হয়।

[৬] অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে বিরোধ’: অস্ট্রিয়া বার্লিনের সন্ধি অস্বীকার করে বসনিয়া ও হারজেগোভিনা দখল করায় সার্বিয়া ক্ষুব্ধ হয়, কারণ এই দুটি অঞ্চলেই সার্ব জাতির লোক বসবাস করত। এই কারণে অস্ট্রিয়া-সার্বিয়া বিরোধ চরম আকার ধারণ করে।

[৭] সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ (১৯০৮ খ্রি.): ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এক ধরনের সংকীর্ণ উগ্র জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে। এই অবস্থায় সুস্থভাবে কূটনৈতিক মত বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই অগ্নিগর্ভ রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে।

[৮] পরস্পর বিরোধী শক্তিজোট গঠন :
দুই সামরিক শিবিরে বিভক্ত অগ্নিগর্ভ ইউরোপ: ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইটালি প্রভৃতি দেশগুলোর মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক, সামরিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ পর্যন্ত ইউরোপকে দুটি পরস্পর-বিরোধী সামরিক শিবিরে বিভক্ত করে। একদিকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইটালির মধ্যে ত্রি-শক্তি মৈত্রীজোট; অপর দিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে ত্রি-শক্তি আঁতাত জোট। দু’পক্ষই যুদ্ধের আশঙ্কায় নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলার ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

[৯] প্রত্যক্ষ কারণ-সেরাজেভো ঘটনা: ‘সেরাজেভো’ ঘটনাটি ছিল এই যে, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্ডিনান্দ ও তাঁর পত্নী বসনিয়া প্রদেশের সেরাজেভো নগরে বেড়াতে যান। সেখানে এক আততায়ীর হাতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ পত্নীসহ নিহত হন। সেরাজেভো ঘটনার অজুহাতে অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে আক্রমণ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয় অর্থাৎ ‘সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড’ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ।-

সুতরাং বলা যায়, ইউরোপে শান্তি বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ঐতিহাসিক ল্যাংসাম লিখেছেন ইউরোপের শান্তি যে-কোনো দুর্ঘটনায় বিঘ্নিত হওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছিল (The Peace of Europe rested an accident)।

Leave a Comment