প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতাগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা
প্লেটোর রাষ্ট্রতত্ত্ব এবং আদর্শ রাষ্ট্রের গুণাবলি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত মূল্যবান ও অভিনবও বটে। তবে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে এই রাষ্ট্রব্যবস্থার নানান ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়।
(i) অবাস্তব চিন্তা: প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে কল্পনার আধিক্য বর্তমান। তিনি যে গুণাবলির দ্বারা আদর্শ রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের সামঞ্জস্য ঘটানো প্রায় অসম্ভব বলে সমালোচকরা মনে করেন। যে কঠোর শিক্ষা পরিকল্পনা প্লেটো পেশ করেছেন, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার সফল রূপায়ণ সম্ভবপর নয় বলেও তারা মতপ্রকাশ করেছেন।
(ii) ব্যক্তিসত্তা উপেক্ষিত: প্লেটো কল্পিত রাষ্ট্রে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আদৌ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র একজন দার্শনিক রাজার উৎকৃষ্টমানের শাসন পরিচালনার উপর নির্ভরশীল এক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে তিনি প্রয়াসী হয়েছিলেন। প্লেটো মনে করতেন, মানুষের নিজস্ব কোনও উদ্যোগ ও স্বাধীনতা নেই- সবটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। এমন ধারণা মানুষের মানবিক সত্তার বিকাশের পক্ষে বাধাস্বরূপ।
(iii) ব্যক্তিইচ্ছা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা: The Laws গ্রন্থে প্লেটো ব্যক্তিমানুষকে অহমিকাসর্বস্ব এবং স্বার্থপর বলে চিহ্নিত করেছেন, যা রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক। প্লেটোর এই ভাবনাকে সমালোচনা করে অধ্যাপক কার্ল পপার (Karl Popper) বিষয়টিকে খ্রিস্টীয় ভাবনার খ্রিস্টানবিরোধী ব্যাখ্যা (Anti-Christian interpretation of Christianity) বলেছেন।
(iv) অগণতান্ত্রিক ধারণা: এথেন্স ছিল গণতন্ত্রের পীঠস্থান- কিন্তু প্লেটো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছেন। তাঁর রাষ্ট্র ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান। প্লেটোর ‘বিশেষ শ্রেণি শাসিত’ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে গেছেন।
(v) শাসকের প্রতি অমানবিকতা: প্লেটোর অভিমত ছিল শাসকের পরিবার ও সম্পত্তি থাকলে তিনি যুক্তিবাদী মন দিয়ে যথাযথভাবে দেশশাসনের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। শাসকদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টি যথেষ্ট অমানবিক।
(vi) ভ্রান্ত সাম্যবাদ: অনেকেই মনে করেন যে, প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের সাম্যবাদ ছিল মানবপ্রকৃতি-বিরোধী, অস্বাভাবিক ও ভ্রান্ত। এতে যেসকল শ্রেণি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। আবার শাসক শ্রেণিকে পরিবার ও সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন তিনি। ফলে সকলের স্বাভাবিক বিকাশ ও সমান অধিকারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল।
(vii) ক্রীতদাস প্রথাকে সমর্থন : প্লেটো ক্রীতদাস প্রথাকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু এমন একটি অমানবিক প্রথাকে টিকিয়ে রেখে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
(viii) জাতিভেদ প্রথাকে সমর্থন: প্লেটোর শ্রেণিবিন্যাস কার্যত জাতিভেদ বা বর্ণভেদ প্রথাকেই সমর্থন করে। কর্মের ভিত্তিতে নাগরিক সমাজের এহেন বিভাজন সামাজিক ঐক্য, সংহতি ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষে বাধাস্বরূপ।
(ix) রাষ্ট্রীয় ঐক্যের ভ্রান্ত ধারণা: প্লেটোর রাষ্ট্রীয় ঐক্যের কিছু শর্তকে অ্যারিস্টটল ‘ভ্রান্তি’ বলেছেন। ব্যক্তিজীবনের বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রের ঐক্যপ্রতিষ্ঠার চিন্তা ছিল একটি ভ্রান্ত ধারণা।
মূল্যায়ন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে নানান সমালোচনা থাকলেও এর গুরুত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। অত্যন্ত কয়েকটি বিষয়ে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পথনির্দেশিকা হতে পারে, যেমন- এথেন্সে নাগরিকদের রাষ্ট্রচেতনা ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব এবং তার কুফল থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য প্লেটো সংযত ও ত্যাগী মানুষকে রাষ্ট্রপ্রধান করতে চেয়েছেন। শাসকের জন্য প্লেটো যে শিক্ষার আবশ্যিকতা উল্লেখ করেছেন, তার বাস্তবতা অনস্বীকার্য। প্লেটোর রাষ্ট্রতত্ত্বে ব্যক্তিশাসককে কঠোরভাবে স্বার্থচিন্তামুক্ত থাকার পরামর্শ দেওয়া আছে। সাধারণ শ্রেণির মানুষকে রাজনৈতিক অধিকার দিতে না চাইলেও, তাদের আর্থিক স্বাধীনতায় প্লেটো হস্তক্ষেপ করেননি।