বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো – সরকারের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলা জুড়ে প্রতিবাদ ওঠে। বাংলার নারীসমাজও এই প্রতিবাদের সামিল হয়।
 
তো চলুন আজকের মূল বিষয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো পড়ে নেওয়া যাক।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা

সরকারের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলা জুড়ে প্রতিবাদ ওঠে। বাংলার নারীসমাজও এই প্রতিবাদের সামিল হয়। এ ব্যাপারে সরলাদেবী চৌধুরাণী সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকা, সরযুবালা দত্ত- সম্পাদিত ‘ভারত মহিলা’ এবং ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। সেদিন পুরুষদের মতো মেয়েরাও গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে সভা-সমিতি করে দেশবাসীকে বিদেশি দ্রব্যাদি বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্যাদি ব্যবহারের আবেদন জানান। ময়মনসিংহের মেয়েরাই সর্বপ্রথম সভা করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং দেশবাসীকে বিদেশি বর্জন ও স্বদেশি ব্যবহারের অনুরোধ করে। কলকাতায় মেয়েদের প্রথম বড়ো সভা হয় ১৩১২ বঙ্গাব্দের ৫ই আশ্বিন। নাটোরের মহারাণী গিরিবালা দেবী-র আহ্বানে এবং শ্রীমতী অবলা বসু-র (বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর পত্নী) উদ্যোগে প্রায় এক হাজার মহিলা মেরী কার্পেন্টার হলে সমবেত হয়ে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং স্বদেশির শপথ গ্রহণ করেন। ১৩১২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘অভয়বাণী’ শীর্ষক এক রচনার মাধ্যমে দেশের পুরুষদের সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

  • ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর সরকারি আইনবলে বাংলাদেশ দু-টুকরো হয়ে যায়। সেদিন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী-র প্রস্তাবক্রমে সারা দেশ জুড়ে পালিত হল ‘অরন্ধন’। কোথাও উনুন জ্বলল না। বাংলার মা-বোনেদের সক্রিয় সমর্থনে ‘অরন্ধন’ সফল হল। জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশবাসীকে দিলেন ‘রাখিবন্ধন’-এর পরিকল্পনা। ‘রাখি’ মিলনের প্রতীক, ঐক্যের প্রতীক- দুই বাংলার সংহতির প্রতীক। সেদিন এই ‘রাখিবন্ধন’-কে কেন্দ্র করে সারা বাংলায় এক অদ্ভুত উন্মাদনা দেখা দেয়। মেয়েরাও প্রবল উৎসাহের সঙ্গে এতে অংশ গ্রহণ করেন। একে অন্যের হাতে রাখি বেঁধে দেন। বৃদ্ধা শাশুড়ির হাতে কিশোরী বধূ, আবার কিশোরী বধুর হাতে বৃদ্ধা শাশুড়ি। এ শুধু কলকাতাতেই নয়- গ্রাম, গল্প, নগর, পুজোর মন্দির, স্নানের ঘাট সর্বত্রই চলল এই অনুষ্ঠান। ‘ভারত মহিলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল রাখির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য। ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল গিরিন্দ্রমোহিনী দাসীর কবিতা- ‘বঙ্গঙ্গনারীর রাখীবন্ধন’। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভাগিনেয়ী সাহানা দেবী (পরবর্তীকালের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী) এবং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কন্যা পুণ্যলতা চক্রবর্তীর স্মৃতিকথায় এসবের বিবরণ মিলবে। সেদিন কলকাতায় আপার সার্কুলার রোডে দুই বাংলার মিলনের প্রতীক ‘মিলন মন্দির’-এর ভিত্তি স্থাপন হল। এই উপলক্ষে যে জনসভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে উপস্থিত ছিলেন আনন্দমোহন বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সভায় উপস্থিত ছিলেন পঞ্চাশ হাজার মানুষ। এর মধ্যে মহিলার সংখ্যা ছিল প্রায় ‘পাঁচশ’। তাদের বসার জায়গা হয়েছিল পার্শ্ববর্তী ‘ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে’। 
  • সারা বাংলা জুড়ে সেদিন চলছে বিদেশি দ্রব্যাদি বর্জন এবং স্বদেশির প্রচার। এই আন্দোলনে বাংলার নারী সমাজের ভূমিকা শুধু গৌরবোজ্জ্বল নয়- অতুলনীয়। তাঁরা গৃহে কোনো বিদেশি দ্রব্যাদি- এমনকী বিদেশি ওষুধও ঢুকতে দিতেন না। বিয়ে, ব্রত, পুজো, শ্রাদ্ধ সর্বত্রই চলল বিদেশি বর্জন। বিদেশি বর্জনে বহুক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি সক্রিয় ছিলেন। বহুক্ষেত্রে তাঁরা স্বেচ্ছায় বিদেশি ধুতি-শাড়ি আগুনে ফেলে দিয়েছেন, ভেঙে ফেলেছেন কাঁচের চুড়ি, বিলিতি নুন-ও তাঁরা স্পর্শ করতেন না। তাঁরা হাসতে হাসতে বিদেশি কাঁচের চুড়ি ভাঙতেন এবং গেয়ে উঠতেন- 

সুরেন দাদা বলে গেছে মতি দাদার বাড়ি/ মেয়েরা সব শাঁখা পরো কাঁচের চুড়ি ছাড়ি।”

আবার সৈন্ধক লবণ দিয়ে ভাত খেতে খেতে গানের সুরে তাঁরা বলে উঠতেন-

“ভূপেন দাদা বলে গেছে শোনরে খোকার মা / রান্নাঘরে বিলিতি নুন আর কখনোও এনো না।”

এখানে ‘সুরেন দাদা’ হলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘মতিদাদা’ হলেন ‘অমৃত বাজার পত্রিকা’-র সম্পাদক মতিলাল ঘোষ এবং ‘ভূপেনদাদা’ হলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পতিতা নারীরাও সেদিন স্বদেশপ্রেম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে স্বদেশির প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। সেদিন বরিশালের বেশ কিছু পতিতা তাঁদের সকল সঞ্চয় ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’-তে দান করেন। 

  • বাংলার মেয়েরা অনেকেই সেদিন ঘরে ঘরে চরকা ও তাঁত চালনা শুরু করে স্বদেশি বস্ত্র তৈরি করতে থাকেন। তাঁতের কাজ, মাটি, মোম, চামড়ার কাজ, স্বদেশি মেলা ও শিল্প প্রদর্শনী প্রভৃতি গঠনমূলক কাজ শুরু হয়। মেয়েদের মধ্যে অনেকেই সেদিন পাড়ায় পাড়ায় স্বদেশি প্রচারে উদ্যোগী হন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কৃষ্ণকুমার মিত্রের স্ত্রী লীলাবতী মিত্র, ডা. নীলরতন সরকারের স্ত্রী নির্মলা সরকার, ডা. প্রাণকৃয় আচার্যের স্ত্রী সুবালা আচার্য, ডা. সুন্দরী মোহন দাসের স্ত্রী হেমাঙ্গিনী দাস। নিজের বাড়ি এবং পাড়াতে তাঁত ও চরকা প্রবর্তনে তাঁরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। 
  • তৎকালীন বাংলার সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গনারীর গৃহ-প্রাকারের বাইরে যাওয়াই ছিল দুষ্কর। এ সত্ত্বেও বহু মহিলা সেদিন সভা সমিতিতে যোগ দিতেন- এমনকী অনেকে প্রকাশ্য সভায় ভাষণও দিতেন। সংখ্যার দিক থেকে নগণ্যা হলেও, তাঁদের ভূমিকা অকিঞ্চিৎকর নয়। জলপাইগুড়ির অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, ময়মনসিংহের পুণ্যলতা গুপ্তা, কাশীর সুশীলা বসুর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। 
  • মহিলা কবি-সাহিত্যিকরাও সেদিন পিছিয়ে ছিলেন না। স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী, হিরন্ময় দেবী, কামিনী রায়, স্বর্ণপ্রভা বসু, কুমুদিনী বসু-র নাম এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। মুসলিম মেয়েরাও সেদিন বসে ছিলেন না। ১৩১২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা ‘নবনূর’ পত্রিকায় খায়রান্নেসা খাতুন-রচিত ‘স্বদেশানুরাগ’ নামক রচনাটি নারী সমাজের প্রতি এক উল্লেখযোগ্য আহ্বান। স্বদেশি আন্দোলনে নারী সমাজের অনবদ্য ভূমিকা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জেমস্ ম্যাকডোনাল্ড-পত্নীও স্বীকার করেছেন।
আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।

Leave a Comment