![]() |
বল্কান যুদ্ধ ও তার গুরুত্ব আলোচনা করো। |
প্রথম অংশ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী দশকে ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত বল্কান অঞ্চলে তুরস্কের দুর্বলতার সুযোগে পদানত জাতিসমূহের মধ্যে জাতীয়তাবাদী প্রত্যাশা প্রবল হয়ে ওঠে, অন্যদিকে বৃহৎ শক্তিবর্গ এখানে নিজ নিজ প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে পারস্পরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। বৃহৎ শক্তিদের মধ্যে অস্ট্রিয়া প্রথমে হস্তক্ষেপ শুরু করে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে শ্লাভ জাতি অধ্যুষিত বসনিয়া ও হারজেগোভিনা দখল করে নেয়।
প্রথম বল্কান যুদ্ধ (১৯১২ খ্রি.)
তুরস্কের দমননীতির বিরুদ্ধে বল্কান রাষ্ট্রগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। মন্টেনিগ্রো, সার্বিয়া, গ্রিস ও বুলগেরিয়া এই চারটি দেশ ‘বল্কান লিগ’ নামে এক মৈত্রীসংঘ গঠন করে এবং এই এলাকায় স্বায়ত্তশাসন দাবি করে এক চরমপত্র পাঠায়। তুরস্ক কর্তৃক এই দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বল্কান লিগের সদস্য রাষ্ট্রগুলি তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে (১৯১২ খ্রি.)। সার্বিয়া ও বুলগেরিয়ার কাছে তুরস্ক শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং তুরস্কের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় দেখা দেয়।
প্রথম বল্কান যুদ্ধের সমাপ্তি
বল্কান রাষ্ট্রগুলির অভাবনীয় সাফল্যে ইংল্যান্ড ভীত হয়ে বল্কান অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে লন্ডনে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহূত হয়। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে লন্ডন চুক্তি দ্বারা প্রথম বল্কান যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে একমাত্র কনস্ট্যান্টিনোপল ও তার সংলগ্ন সামান্য এলাকা ছাড়া বল্কান অঞ্চলে তুরস্কের আধিপত্য নির্মূল হয়।
দ্বিতীয় বল্কান যুদ্ধ (১৯১৩ খ্রি.)
প্রথম বল্কান যুদ্ধ শেষ হলেও বল্কান অঞ্চলের সমস্যা প্রশমিত হয়নি, কারণ বল্কান অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের ওপর ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে বল্কান দেশগুলি পারস্পরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ম্যাসিডোনিয়ার ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে গিয়ে সার্বিয়া ও বুলগেরিয়ার মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত হয়। গ্রিস ও রুমানিয়া সার্বিয়ার পক্ষ নেয় এবং তুরস্কও বুলগেরিয়া-বিরোধী জোটে যুক্ত হয়। চতুর্দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে বুলগেরিয়া শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। অবশেষে বুখারেস্ট-এর সন্ধি (১৯১৩ খ্রি.) দ্বারা বুলগেরিয়া সার্বিয়া ও গ্রিসকে ম্যাসিডোনিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল ছেড়ে দেয়। রুমানিয়াও বুলগেরিয়ার কিছু অংশ পায়।
দ্বিতীয় অংশ
প্রথম ও দ্বিতীয় বল্কান যুদ্ধ বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল এবং এই দুটি বল্কান যুদ্ধের ফলে-
[১] তুরস্ক সাম্রাজ্যের প্রায় অবলুপ্তি: ইউরোপে তুরস্ক সাম্রাজ্যের প্রায় অবলুপ্তি ঘটে। তুরস্ক তার সাম্রাজ্যের চার- পঞ্চমাংশ স্থান হারায় এবং তুরস্কের স্থলে এখন থেকে রাশিয়া বল্কান অঞ্চলের অভিভাবক ও রক্ষকের স্থান অধিকার করে।
[২] সার্বিয়া-অস্ট্রিয়া দ্বন্দ্বের সূচনা: বল্কান রাজ্যগুলির মধ্যে সার্বিয়ার মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেল এবং অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে ধ্বংস করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠে। অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে এভাবে যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয় তার সূত্র ধরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হল। ম্যাক বেল্টীয়াল
[৩] ইউরোপের কূটনৈতিক বিন্যাস: বল্কান যুদ্ধের ফলে ইউরোপের কূটনীতির ক্ষেত্রেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যেমন তুরস্ক ও বুলগেরিয়া দুর্বল হয়ে পড়ায় দুটি দেশ যথাক্রমে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার পক্ষ নেয় অন্যদিকে রাশিয়া সার্বিয়ার মুখ্য সমর্থকে পরিণত হয়। এই পারস্পরিক সম্পর্কের বিন্যাস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট রচনা করে।