বিড়াল প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ও নামকরণ

বিড়াল প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ও নামকরণ

বিড়াল প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ও নামকরণ
বিড়াল প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ও নামকরণ

বিড়াল প্রবন্ধের বিষয়বস্তু

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ একটি অভিনব এবং বঙ্কিম-প্রতিভার সর্বোৎকৃষ্ট ফসল। তার মধ্যে ‘বিড়াল’ প্রবন্ধটি আবার বিশেষত্বের দাবি রাখে। কেন-না, এটি একটি রূপকধর্মী রচনা। বঙ্কিমচন্দ্র হাসির ছলে যে গভীর কথা বলতে পারতেন, তাঁর প্রমাণ এই ‘বিড়াল’ প্রবন্ধটি।

বিড়াল’ নকশা জাতীয় ব্যঙ্গ রচনা। ঘটনা এবং কাল্পনিক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে লেখক সমাজের একটি অন্ধকার দিক ফুটিয়ে তুলেছেন। একটি ক্ষুধার্ত বিড়াল, যে কমলাকান্তের কাছে প্রায় আসত, সে-ই একদিন কমলাকান্তের জন্য রেখে দেওয়া দুধ খেয়ে ফেলেছে। পরম তৃপ্তি তার। তা দেখে লেখক হাস্যোচ্ছলে নিজেকে নেপোলিয়ন ভেবে বিড়ালের সঙ্গে ওয়াটার্ল যুদ্ধ জিততে পারতেন কিনা, তা চিন্তা করছেন, এমন সময় বিড়াল ডেকে উঠেছে ‘মেও’। নেশার ঘোরে তিনি প্রথমে মনে করেছেন যে, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়েছে এবং তাঁর কাছে আফিম চাইতে এসেছে। কিন্তু বিড়াল মনে মনে ভেবেছে, “কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই।”

এখন কথা হল, দুধ কমলাকান্তের বাপের নয়, প্রসন্ন গয়লানীরও নয়, দুধ মঙ্গলা গাইয়ের। তাই কমলাকান্তের তাতে কোনো অধিকার নেই; বা বলা যেতে পারে তাতে বিড়ালের যা অধিকার, কমলাকান্তেরও তা-ই।

অতঃপর একটা ভাঙা লাঠি নিয়ে কমলাকান্ত যেই বিড়ালকে শাসন করতে যাবে, অমনি বিড়াল প্রশ্ন তুলেছে, “তোমরা মনুষ্য, আমরা বিড়াল, প্রভেদ কি? তোমাদের ক্ষুৎপিপাসা আছে-আমাদের কি নাই?” এই প্রশ্ন কমলাকান্তকে টলিয়ে দিল। কমলাকান্ত ভাবতে লাগলেন, সামান্য খাদ্যের জন্যই পৃথিবীতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এবং নানা অসংগতির সৃষ্টি হয়েছে। বিড়ালের প্রশ্নে তিনি মর্মবিদ্ধ হলেন। ভাবলেন, সত্যিই তো, ‘খাইতে পাইলে কে চোর হয়?’ তাঁর মনে হল, বিড়াল ঠিকই বলেছে যে, ‘চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শত গুনে দোষী।’

বিড়াল বলেছে যে, তারা পাঁচিলে পাঁচিলে ‘মেও মেও’ করে ডেকে বেড়ায়, এঁটো পাতের মাছের কাঁটা খায়, কিন্তু তাতে তাদের পেট ভরে কিনা সে খোঁজ কেউ রাখে? কেউ না। যদিও সভ্য সমাজে একটা বিড়ালের কথা ভেবে দুঃখ পাওয়া লজ্জার কথা, তবুও সেটা কি নিতান্তই অসংগত?

বিড়ালের যুক্তি অকাট্য। সে বলেছে, ওই দুধটুকু যদি কোনো শিরোমণি কিংবা ন্যায়ালংকার খেতেন, তবে কমলাকান্ত তাঁকে লাঠি নিয়ে তেড়ে যেতেন না। এইভাবে গভীর একটি সামাজিক সমস্যা তুলে ধরেছে বিড়াল।

অবশেষে কমলাকান্ত হার মেনেছেন। আর কোনো উপায় না দেখে বিড়ালকে ধার্মিক হতে বলেছেন। কেন-না, বিড়ালের কথাগুলো বড়ো সোশিয়ালিস্টিক। এই সোশিয়ালিজমই সমাজের অশান্তির মূল কারণ। কারণ, এটাই নিরন্ন মানুষকে অন্ন লাভের জন্য প্রতিবাদী করে তোলে, আন্দোলনের উত্তেজনা ছড়ায়, শাসনতন্ত্র বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তবে, বিড়ালকে কোনো ধর্মের কথা বোঝাতে পারেননি কমলাকান্ত। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পরের দিন তিনি বিড়ালের সঙ্গে ছানা ভাগ করে খাবেন। আর নিতান্ত খিদে পেলে এক সরিষার মতো আফিমও দিতে পারেন। এইভাবেই তো ক্ষুধায় জর্জরিত মানুষকে সাম্রাজ্যবাদী সমাজ ধর্মের আফিম খাইয়ে নিস্তেজ করে রাখে। কিন্তু কমলাকান্ত যে একটি পতিত আত্মাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসেছেন, এটা ভেবে তিনি খুব তৃপ্ত হয়েছেন।

বিড়াল প্রবন্ধের নামকরণ

‘বিড়াল’ একটি রূপকধর্মী রচনা। এখানে বঙ্কিমচন্দ্র সমাজতন্ত্রবাদ ও ধনতন্ত্রবাদ-এই দুইয়ের পরস্পরবিরোধী মতবাদের আলোচনা সাপেক্ষে পৃথিবীর দরিদ্র জাতির কান্নাই ফুটিয়ে তোলেননি, তার সমাধানের পথও নির্দেশ করেছেন। ফরাসি পণ্ডিত রুশোর সাম্যবাদের মূলসূত্রটির অবলম্বনে তিনি মানবসমাজের আর্থিক বৈষম্যের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করেছেন।

‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বিড়ালটি খেতে পায় না, ফলে এঁটো-কাঁটা খায়। সে একদিন খিদের তাড়নায় কমলাকান্তের জন্য রেখে দেওয়া দুধ আত্মসাৎ করে ফেলে।

এবার সমগ্র প্রবন্ধটিতে বিড়ালের জবানবন্দিতে অকাট্য যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। বিড়াল বলতে চায়, সে যতই ছোটো প্রাণী হোক-না-কেন, তারও খিদে আছে। এই সমাজ তাকে খেতে দেয় না, ঠিক যেমন দরিদ্ররা অভুক্ত থাকে এই ধনতান্ত্রিক সমাজে। তাই বিড়ালের বক্তব্য, সে যদি পেট ভরে খেতে পেত, তাহলে সে চুরি করত না কোনোদিন। এই সমাজ চোরকে দোষ দেয় বটে, কিন্তু যে কৃপণ ধনী, যে অন্যের টাকা আত্মসাৎ করে ধনের পাহাড় জমিয়েছে, সে-ই সৃষ্টি করেছে বৈষম্য। তাঁর জন্যই দরিদ্রকে চুরি করতে হয়। তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্য জাতির রোগ। যার সম্পদ আছে, টাকা আছে, তার সম্মানও আছে। আর দরিদ্ররা জ্ঞানী হলেও কেউ তাদের আমল দেয় না। বিড়ালের এই অকাট্য যুক্তি মেনে নিতে হয় কমলাকান্তকে।

তাই বিড়াল হয়ে ওঠে একটি সমাজ বিপ্লবের প্রতিভূ, একটি জড় সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সূচক, একটা প্রতিবাদের ভাষা, একটা সাম্যবাদীর স্বপ্ন।

এইভাবে আমরা দেখি, আলোচ্য প্রবন্ধে বিড়ালটি হয়ে উঠেছে একটি মুখ্য চরিত্র। যে ভণ্ডামি দিয়ে ধনতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠেছে, যে তোষণ দিয়ে মানুষের চরিত্র নষ্ট করেছে ধনবাদ, যে নির্দয়তাকে মানুষ বরণ করে নিয়েছে, যে অন্ধত্ব মানব চরিত্রকে গ্রাস করেছে, তার বিরুদ্ধে বিড়ালের ঘৃণা ও ধিক্কার বর্ষিত হয়েছে।

এইজন্য, বিড়ালের রূপ ধরে পৃথিবীর একটা বড়ো শ্রেণির মনের কথা ও স্বপ্নের কথা কমলাকান্ত ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই প্রবন্ধটির চরিত্রকেন্দ্রিক নামকরণ অবশ্যই সার্থক।

Leave a Comment