বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা

ভূমিকা

রবীন্দ্রনাথ জীবনের সর্বভূমির কবি। তাঁর বিচিত্র চিন্তা ও কর্মের প্রবাহ, বিচিত্র প্রকাশের মধ্যে, তাঁর সাহিত্য রচনায়, বিচারে ও ব্যাখ্যানে যে পরিচয়টি আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়, তা হল তাঁর কবিপ্রকৃতি। রবীন্দ্রনাথের মতো মনে-প্রাণে, চিন্তায়-কর্মে, দুঃখে-সুখে, জীবনে-মরণে সমদৃষ্টিমান কবি মানুষের ইতিহাসে দুর্লভ। জগৎকে তিনি দেখেছেন ঋষিসুলভ অখণ্ড দৃষ্টিতে যার মাধ্যমে আনন্দরূপকে উপলব্ধি করেছেন। তাঁর কবিপ্রকৃতি সীমার সঙ্গে অসীমের, খণ্ডের সঙ্গে পূর্ণের, ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে বিশ্বজীবনের চিরন্তন প্রবাহ উপলব্ধি করে তিনি আকণ্ঠ ডুব দিয়েছেন এবং সেই অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করেছেন সাহিত্যে। শরৎচন্দ্রের মতো আমরাও বলছি, “কবিগুরু, তোমাদের প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই।”

জীবনী

কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পুত্র রবীন্দ্রনাথের জন্ম (২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮/৭ই মে, ১৮৬১)। শৈশব থেকে আমৃত্যু তিনি নানা স্থানে ঘুরেছেন, বিভিন্ন স্থানে থেকেছেন, অভিজ্ঞতার ঝুলি সঞ্চিত করেছেন এবং রেখে গেছেন তাঁর জীবনব্যাপী কর্মসাধনার অসামান্য কীর্তিকে। জীবনে বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছেন, প্রিয়জনদের অকাল বিয়োগকে কাছে থেকে দেখেছেন, পরাধীন ভারতবর্ষে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করার জন্য নানান কর্মপন্থা গ্রহণ করেছেন। শিলাইদহে জমিদারী দেখাশোনা কালে সাধারণ মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন, শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এসবের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মযজ্ঞকে প্রসারিত করে দিয়েছেন। ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। অন্যদিকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধিও ত্যাগ করেছেন। এই কবি ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হয় ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে (৭ আগস্ট, ১৯৪১)।

কবি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নবজাতক’ কাব্যের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “আমার কাব্যের ঋতু পরিবর্তন ঘটেছে বারে বারে।” অর্থাৎ তাঁর সমগ্র কাব্য সাধনায় এসেছে ক্রমিক পরিবর্তনের রূপ। কবি জীবনের এক একটি পর্যায় স্তরে স্তরে বিচিত্র ভাবরসের ভিতর দিয়ে প্রত্যেক স্তরের বিচিত্র সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষিত করে অবশেষে তার সহজ স্বাভাবিক পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছে এবং সমাপ্তির সীমায় পৌঁছে পরমুহূর্তেই আবার সেই সীমাকে উল্লঙ্ঘন করে নূতন প্রবাহের সূচনা করেছে। নিত্য নূতন করে নূতন সৃষ্টির মধ্যে বিহারই রবীন্দ্র কবিজীবনের ধর্ম। ‘কল্পনা-ক্ষণিকা-নৈবেদ্য-খেয়া’ হয়ে যে নবজীবন প্রবাহের সূচনা হয়েছিল তা গীতাঞ্জলি-গীি তমাল্য-গীতালির মধ্যে নিঃশেষে আত্মপ্রকাশ করেছে। এরপর বলাকা, পূরবী ও মহুয়া থেকে পুনশ্চ, শেষসপ্তক কাব্যগুলিতে নব নব চিন্তাভাবনা যেমন উৎসারিত হয়েছে তেমনি শেষ পর্যায়ের কাব্যগুলিতে মর্ত্যপ্রীতি ও মানুষের প্রতি গভীর নৈকট্য স্থাপিত হয়েছে-যা তাঁর নব নব উন্মেষশালিনী প্রতিভার পরিচায়ক।ত

প্রাবন্ধিক

রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ তাঁর জীবননিষ্ঠ মননের ভাষ্য। ভারতী, সাধনা, ভাণ্ডার, বঙ্গদর্শন (নবপর্যায়) পত্রিকার সম্পাদনা সূত্রেই তাঁর বেশিরভাগ প্রবন্ধগুলি রচিত হয়। তাঁর প্রবন্ধগুলি তথ্য ও তত্ত্বে সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল, যুক্তি ও বিচার-বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণতায় সমৃদ্ধ। শিল্প ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা, আর্থ-রাজনৈতিক চিন্তা, সমাজ-সংস্কার সম্পর্কিত সমস্যা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ই রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

নাট্যকার

রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি হলেও নাট্যকার রূপে তাঁর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। বিশেষ করে রূপক-সাংকেতিক নাটকে তাঁর কৃতিত্ব অবিসংবাদিত। রক্তকরবী, রাজা, মুক্তধারা, ডাকঘর প্রভৃতি নাটকগুলির নাট্যবস্তু ও রসাবেদন এখনো মানুষকে আকর্ষণ করে। শুধু নাটক রচনা নয়, নাট্যমঞ্চ, নাট্য প্রযোজনা, নাট্যাভিনয় সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আধুনিক। নাটকের বিষয়, চরিত্র, সংলাপ, সংগীত প্রভৃতি তাঁর নাট্যস্বভাবের পরিচয়বহ। নাটক যে একটি সূক্ষ্ম কলারূপ-তিনিই প্রথম দেখালেন

ঔপন্যাসিক

ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের বাঙালির ভাবজীবন রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের বিষয়। এই সময়ের ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি ও ব্যক্তির দ্বন্দু, ব্যক্তির সঙ্গে সংসারের দ্বন্দু, হিন্দু ব্রাহ্মের ভাবসংঘাত, রাজনীতি ও স্বদেশপ্রেম, ব্যক্তির অন্তর্মুখীনতা প্রভৃতি রবীন্দ্রনাথের ঔপন্যাসিক চেতনাকে সমগ্রতা দান করেছিল। ‘চোখের বালি’ থেকেই বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে মোড় ফেরার ঘণ্টাধ্বনি সূচিত হয়। ‘গোরা’-র মধ্যে প্রকাশিত হয় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের এক সময়ের সামগ্রিক রূপ। বঙ্গভঙ্গের পটভূমিকায় রচিত হয় ‘ঘরে বাইরে’। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে আঙ্গিকের বৈচিত্র্য চমকপ্রদ। আর ‘শেষের কবিতা’র মতো রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস কমই আছে।

ছোটগল্পকার

পদ্মাতীরে জমিদারী দেখাশোনার অবকাশে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের অংশভাগী হয়ে তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, তার বেশির ভাগই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ছোটগল্পে। গল্পগুলিতে এসেছে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি ও মানুষ, মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-নৈরাশ্য, নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, গ্রামীণ জীবনের সংস্কার বিশ্বাস, অতিপ্রাকৃত উপাদান প্রভৃতি। গল্পের আঙ্গিক ও শিল্পকৌশলও অনবদ্য। ছুটি, পোস্টমাস্টার, একরাত্রি, সুভা, ক্ষুধিত পাষাণ, দান প্রতিদান, জীবিত ও মৃত, স্ত্রীর পত্র, ল্যাবরেটরি প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প। চরিত্রের বিবর্তন, নাটকীয় সমাপ্তি, অতিপ্রাকৃত উপাদানকে মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের কাজে লাগানো, প্রকৃতির উন্মুক্ত পটভূমিকায় মানবমনের বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছোটগল্পকার।

সংগীত

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল এক সংগীত-পিপাসু হৃদয়-যা দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীত। আনন্দে, বেদনায়, দুঃখে, সুখে, উৎসব-অনুষ্ঠানে, মিলনে-বিরহে, জীবনে-মৃত্যুতে তাঁর সেইসব গানগুলি মানুষকে প্রেরণা দেয়, শান্ত করে, উজ্জীবিত করে।

উপসংহার

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল এক ঋষিসত্তা, যে সত্তা দিয়ে তিনি সমস্ত খণ্ডের মধ্যে অখণ্ড দেখেছেন, হিংসা-বিদ্বেষের মধ্যে প্রেমকে উপলব্ধি করেছেন, অন্ধকারের উৎসে আলোর সন্ধান করেছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খলে দেশবাসীর ক্লীবতা ও দীনতাকে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি ক্ষুদ্র, খন্ড, দ্বেষ, হিংসা, দীনতা ক্লীবতা-র ঊর্ধ্বে উঠে গভীর মানব প্রত্যয় নিয়ে শাশ্বত জীবনের কথা শুনিয়েছেন। সেই সমগ্র জীবনের কবি রবীন্দ্রনাথ-খার মধ্যে অখণ্ড ভারত আত্মার সন্ধান পাওয়া যায়।

Leave a Comment