বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের মহান রুশ বিপ্লব সমগ্র বিশ্বে এক প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ও শ্রমিকশ্রেণির একাংশ এবং হতাশাগ্রস্ত বিপ্লবীদের অনেকেই এই যুগান্তকারী ঘটনার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন।
তো চলুন আজকের মূল বিষয় বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা পড়ে নেওয়া যাক।
বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

|
বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা |
বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
রুশ বিপ্লবের প্রভাব
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের মহান রুশ বিপ্লব সমগ্র বিশ্বে এক প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ও শ্রমিকশ্রেণির একাংশ এবং হতাশাগ্রস্ত বিপ্লবীদের অনেকেই এই যুগান্তকারী ঘটনার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। কংগ্রেসি রাজনীতি ও বিপ্লববাদী রাজনীতির কার্যকারিতায় সন্দিগ্ধ হয়ে তাঁরা রুশ বিপ্লবের আদর্শে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমে দেশবাসীর মুক্তির স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এই সময় দৈনিক বসুমতী, আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারতবর্ষ, মডার্ন রিভিউ, অমৃতবাজার পত্রিকা এবং ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকাগুলিতে বলশেভিক বিপ্লব ও লেনিন সম্পর্কে নানা সংবাদ ও প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে সভানেত্রীর ভাষণে শ্রীমতী অ্যানি বেশান্ত বুশ বিপ্লবের আদর্শের কথা বলেন।
কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা (১৯২৬ খ্রিঃ)
সূচনা: বিপ্লবী ‘যুগান্তর’ দলের সদস্য এবং বাঘা যতীনের ঘনিষ্ঠ অনুগামী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (মানবেন্দ্রনাথ রায় নামে সমধিক পরিচিত) ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ বা জনক-রূপে পরিচিত। ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত করার উদ্দেশ্যে জার্মান অস্ত্রের আশায় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বাঘা যতীনের নির্দেশে তিনি বাটাভিয়ায় পাড়ি দেন। বাঘা যতীনের বিপ্লব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। বাটাভিয়ায় গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য নরেন্দ্রনাথ জার্মান জাহাজে করে প্রথমে আমেরিকা এবং পরে মেক্সিকোতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মেক্সিকোয় তিনি সোস্যালিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং সেখানেই তিনি মার্কসবাদে দীক্ষিত হন। তাঁর নেতৃত্বে অবনী মুখার্জী, মহম্মদ আলি প্রমুখ চব্বিশজন প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর রাশিয়ার তাসখন্দে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। সাতজনকে নিয়ে এই দলের কর্মসমিতি গঠিত হয়। মহম্মদ সিদ্দিকি এর সম্পাদক নিযুক্ত হলেও মানবেন্দ্রনাথই ছিলেন এই দলের সর্বেসর্বা। পরের বছর (১৯২২ খ্রিঃ) এই দল ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ বা ‘কমিনটার্ন-এর স্বীকৃতি লাভ করে।
বিকাশ
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে ভারতের কলকাতা, বোম্বাই, লাহোর, মাদ্রাজ প্রভৃতি স্থানে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। কলকাতায় এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিলেন মুজাফফর আহমদ। অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানকারী বোম্বাই-এর তরুণ ছাত্র শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ‘গান্ধী বনাম লেনিন’ নামে একটি ইংরেজি পুস্তিকা রচনা করে • গান্ধীনীতির তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি ‘দি সোস্যালিস্ট’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি ছিল ভারতে প্রকাশিত প্রথম কমিউনিস্ট পত্রিকা। লাহোরে গোলাম হোসেন ছিলেন সাম্যবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ। গোলাম হোসেন সম্পাদিত উর্দু মাসিকপত্র ‘ইনকিলাব’ ছিল লাহোর গোষ্ঠীর মুখপত্র। মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার সাম্যবাদী গোষ্ঠী গঠন করেন (১৯২২ খ্রিঃ)। এই গোষ্ঠীর মুখপত্র ছিল ‘লেবার কিষাণ গেজেট’। ১৯২৩-২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে করাচি, কানপুর, বারাণসী ও অন্যান্য বৃহৎ শিল্পাঞ্চলগুলিতে বেশ কিছু কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। ভারতে কমিউনিস্ট মতাদর্শ ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে এ সময় বেশ কিছু পত্র-পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। এগুলির মধ্যে কলকাতার ‘আত্মশক্তি’ ও ‘ধুমকেতু’, গুন্টুরের ‘নবযুগ’, বোম্বাই-এর ‘ক্রান্তি’, লাহোরের ‘কীর্তিকিষাণ’ ও ‘ইনকিলাব’, যুক্তপ্রদেশের ‘অসন্তিকারী’, মাদ্রাজের ‘ওয়ার্কার ‘উল্লেখযোগ্য।
সরকারী দমন-পীড়ন
ভারতে সাম্যবাদের প্রসার রোধ করার উদ্দেশ্যে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে। ১৯২২-২৩ খ্রিস্টাব্দে সরকার রাশিয়া থেকে গোপন পথে ভারতে আগত কিছু বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে। পেশোয়ার কোর্টে তাঁদের বিচার হয় এবং তাঁরা দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এই মামলা ‘পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা’ বা ‘প্রথম বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। এই মামলাই ভারতের প্রথম কমিউনিস্ট-বিরোধী মামলা। ১৯২২ থেকে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাঁচটি পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা হয়। কমিউনিস্ট আন্দোলন দমন করার জন্য ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ সরকার মুজাফ্ফর আহম্মদ, এস. এ. ডাঙ্গে, নলিনী গুপ্ত এবং শওকত ওসমানী-কে গ্রেপ্তার করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে। এই মামলা ‘দ্বিতীয় বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা’ বা ‘কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে খ্যাত। এই মামলায় তাঁদের চার বছর করে জেল হয়। এই সব দমননীতির ফলে কমিউনিস্ট আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হলেও স্তব্ধ হয়ে যায়নি।
‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’-র প্রতিষ্ঠা (১৯২৬ খ্রিঃ)
পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা ও কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা ভারতে কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের কমিউনিস্টরা যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য একটি সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই মর্মে ১৯২৫ সালের ২৬শে ডিসেম্বর কানপুরে প্রথম সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতি ছিলেন মাদ্রাজের প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা সিঙ্গারাভেলু চেট্রিয়ার। এই সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুজাফফর আহম্মদ, এস. বি. ঘাটে, কে. এন. যোগলেকর, আর. এস. নিম্বকর প্রমুখ। এই অধিবেশনেই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। বোম্বাই-এর শ্রমিক নেতা এস. বি. ঘাটে ছিলেন এই দলের প্রথম সাধারণ সম্পাদক। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আক্ষরিক অর্থেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ‘দ্বিজ’। তার জন্ম দু’বার-একবার তাসখন্দ, আরেকবার কানপুরে। এই সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি, বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা ও মুসলিম লিগ সভাপতি মৌলানা হজরৎ মোহানী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, এই নবগঠিত দলের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই-এটি নিছক একটি ভারতীয় সংস্থা। সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার এ ব্যাপারে আরও বেশি সোচ্চার হয়ে ঘোষণা করেন যে, “ভারতের কমিউনিজম বলশেভিজম” নয়।
‘ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পেজান্টস পার্টি’
১৯২০ সাল থেকে ভারতে ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি বলে ঘোষিত না হলেও তাদের পক্ষে খোলাখুলিভাবে কাজ করার বেশ অসুবিধা ছিল। এই অসুবিধা দূর করে শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থে খোলাখুলি কাজ করার জন্য ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দি লেবার স্বরাজ পার্টি অফ দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’। কংগ্রেস ও স্বরাজ্য দলের রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ কিছু জাতীয়তাবাদী এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এর উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন কুতুবউদ্দিন আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, একদা চিত্তরঞ্জন দাশের সচিব অধ্যাপক হেমন্ত সরকার প্রমুখ। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিলাভের পর মুজাফ্ফর আহমদ ও নলিনী গুপ্ত এই দলে যোগ দেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে গোপেন চক্রবর্তী, ধরণী গোস্বামী প্রমুখ অনুশীলন সমিতির সদস্যরা এই দলে যোগ দেন। পরে (১৯২৮-এর মার্চ মাসে) এই দলের নাম পরিবর্তিত হয়ে হল ‘ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পেজান্টস পার্টি’। এই দলের মুখপত্র ছিল প্রথমে সাপ্তাহিক ‘লাঙ্গল’ (২৫শে ডিসেম্বর, ১৯২৫ খ্রিঃ), পরে এর নাম পরিবর্তন করে হয় ‘গণবাণী’ (১২ই আগস্ট, ১৯২৬ খ্রিঃ)। এরপর একে একে বোম্বাই, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানেও অনুরূপ ‘ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পেজান্টস্ পার্টি’ গড়ে ওঠে। এইভাবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই সব আঞ্চলিক শ্রমিক-কিষাণ দল গড়ে উঠতে থাকে। নেতৃবৃন্দ একটি সর্বভারতীয় দলের প্রয়োজন অনুভব করেন। এই মর্মে ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের সময়েই কলকাতায় এই দলের সর্বভারতীয় সম্মেলন ডাকা হয়। এখানে আর. এস. নিম্বকার এই সর্বভারতীয় দলের সম্পাদক নিযুক্ত হন। এই দল শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থরক্ষা, জমিদারি প্রথার অবসান এবং পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানায়। এই দলের উদ্যোগে ৩০ হাজার শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের এক বিশাল মিছিল অধিবেশন-রত জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চের কাছে গিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানায়। জওহরলাল নেহরু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ শ্রমিকদের সামনে ভাষণ দেন।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ‘সাইমন কমিশন’ বয়কট আন্দোলন ও মিছিলে কমিউনিস্টরাও কংগ্রেসের সঙ্গে যোগ দেয়।
কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক দল
বিশ শতকের বিশের দশক থেকে জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পেতে থাকে। কংগ্রেসের দুই তরুণ নেতা সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহরুর মধ্যে বামপন্থী মতাদর্শের পূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায়। এই দুই নেতাই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আপসহীন সংগ্রাম ও সমাজবাদী চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোর কংগ্রেসে সভাপতির ভাষণে জওহরলাল নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলে অভিহিত করেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারত কোন পথে’ (Whither India) শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি সকল কায়েমি স্বার্থ ও শ্রেণিগত সুবিধা সমূলে বিনষ্ট করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। তিনি প্রকাশ্যে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রবাদকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে ঘোষণা করেন। আইন অমান্য আন্দোলনের সময় ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে নাসিক জেলে অবস্থানকালে জাতীয় কংগ্রেসের বামপন্থী যুবগোষ্ঠীভুক্ত জয়প্রকাশ নারায়ণ, অচ্যুত পট্টবর্ধন, ইউসুফ মেহের আলি, অশোক মেহতা, মিনু মাসানি কংগ্রেসের অভ্যন্তরে একটি সমাজতন্ত্রী দল গঠনের পরিকল্পনা করেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে বোম্বাই-এ অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রী সম্মেলনে ‘কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল’ বা ‘কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের প্রতিষ্ঠা কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী শক্তিবৃদ্ধির কথাই প্রমাণিত করে। জয়প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন এই নবগঠিত দলের সম্পাদক। এই দলের লক্ষ ও মূল উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী শক্তিকে সুসংহত করা, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন এবং উৎপাদনকারী শক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তারা চাইত শিল্পের সমাজতন্ত্রীকরণ, বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, দেশীয় রাজা ও জমিদারদের বিলুপ্তি, কৃষিঋণ মকুব ও কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন, রাষ্ট্র কর্তৃক কাজের অধিকারের স্বীকৃতি দান এবং শ্রমিককে তার প্রয়োজন অনুসারে পারিশ্রমিক দান। কমিউনিস্টরা এই দলের সদস্য হন। কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী এই দলের অর্থনৈতিক কর্মসূচি মানতে পারেনি। জওহরলাল নেহরু এই দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চললেও নিজে কিন্তু এর সদস্য হননি। তাঁর উদ্যোগে আচার্য নরেন্দ্র দেব, জয়প্রকাশ নারায়ণ ও অচ্যুত পট্টবর্ধন এই তিনজন সমাজতন্ত্রী নেতা কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্য মনোনীত হন। জাতীয় রাজনীতিতে এই দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এই দলের প্রভাবেই সুভাষচন্দ্র ত্রিপুরী কংগ্রেসে সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। এই দলের প্রভাবেই জাতীয় কংগ্রেস কৃষিসংস্কার, ভূমিসংস্কার, শিল্প-বিরোধের সমস্যা ও দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের সমস্যার দিকে নজর দিতে বাধ্য হয়। বিহার, কেরালা, যুক্তপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে এই দল সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। শ্রমিক আন্দোলনেও এই দলের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। সমাজতন্ত্রীদের প্রভাবের ফলেই ১৯৩৭-এর নির্বাচনে কংগ্রেস ব্যাপক সফলতা লাভ করে।
ত্রিপুরী কংগ্রেস (১৯৩৯ খ্রিঃ)
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরী (মধ্যপ্রদেশ) কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য পুনরায় সুভাষচন্দ্রকে সভাপতি করার দাবি উত্থাপিত হয়। নাম্বুদিরিপাদ, সুন্দরাইয়া, সজ্জাদ জহীর প্রমুখ আটজন বিক্ষুব্ধ বামপন্থী নেতা এই দাবি উত্থাপন করেন। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘নিউ এজ’-এও এই দাবি ওঠে। এতদিন পর্যন্ত গান্ধীজিই কংগ্রেস সভাপতি মনোনীত করতেন এবং এর বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন উঠত না। সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বারের জন্য এই পদপ্রার্থী হলে গান্ধীজি আপত্তি জানান। শেষ পর্যন্ত, নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র জয়ী হলেও, তাঁর পক্ষে কংগ্রেসে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। তিনি কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী অংশকে ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট হন। তিনি একটি ‘বাম সমন্বয় কমিটি’ (Left Con- solidation Committee) গঠন করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি জাতীয় কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই ইংরেজ সরকার ভারতকে ‘যুদ্ধরত দেশ’ বলে ঘোষণা করে। ভারতকে এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জড়িয়ে দেওয়ায় জাতীয় কংগ্রেস তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই যুদ্ধকে ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করে দেশজুড়ে যুদ্ধবিরোধী প্রচার চালায়। তারা ‘এক পাই নয়, এক ভাই নয়’ ধ্বনি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে ভারত থেকে এক পাই এবং একটি মানুষও না পাঠাবার জন্য প্রচারে অবতীর্ণ হয়। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করায় ভারতীয় কমিউনিস্টরা ব্রিটিশ বিরোধী নীতি ত্যাগ করে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সামিল হয় এবং ব্রিটেন ও রাশিয়ার যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ আখ্যা দেয়।
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি তার বিরোধিতা করতে থাকে। তারা মনে করে যে, যুদ্ধরত ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করা ঠিক হবে না। তারা সুভাষচন্দ্র, ফরওয়ার্ড ব্লক ও জয়প্রকাশ নারায়ণকে ‘পঞ্চম বাহিনী’ এবং গান্ধীজিকে ‘ধূর্ত বুর্জোয়া নেতা’ ও তাঁর অহিংস নীতিকে ‘দেউলিয়া’ নীতি বলে অভিহিত করে। বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা গঙ্গাধর অধিকারী তাঁর থিসিসে মুসলিম লিগের পাকিস্তান দাবি সমর্থন করেন এবং বলেন যে, পাকিস্তান দাবি সমর্থন করে তিনি ব্রিটিশ সরকারের হাত শক্ত করতে চান।
মানবেন্দ্র নাথ রায় ও ভারতের বামপন্থী আন্দোলন
প্রখ্যাত বিপ্লবী এবং ভারতে ‘র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম’-এর প্রবক্তা মানবেন্দ্র নাথ রায়ের (১৮৮৭-১৯৫৪ খ্রিঃ) প্রকৃত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। দরিদ্র পরিবারের সন্তান নরেন্দ্রনাথ অল্প বয়সেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন এবং এই অপরাধে দক্ষিণ ২৪ পরগণার হরিনাভি স্কুল থেকে বিতাড়িত হন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জার্মান অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাঘা যতীনের নির্দেশে তিনি বাটাভিয়ায় যান। সেখানে থেকে আমেরিকা, তারপর মেক্সিকোতে যান এবং মার্কসবাদে দীক্ষিত হন। ভারতে বামপন্থী আন্দোলন বা কমিউনিস্ট মতাদর্শ বিস্তারে তাঁর অবদান বিরাট। ১৯৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দের পর তিনি কমিউনিস্ট মতবাদ ত্যাগ করে ‘র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম’ বা ‘নবমানবতাবাদ’ প্রচার করতে শুরু করেন।
আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।