ভিয়েনা সম্মেলন টীকা

ভিয়েনা সম্মেলন টীকা
ভিয়েনা সম্মেলন টীকা

ভিয়েনা সম্মেলনের পটভূমি

রাজ্যজয় ও সাম্রাজ্য বিস্তারের দ্বারা নেপোলিয়ন ইউরোপের মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। তাই তাঁর নির্বাসনের পর ইউরোপীয় রাজ্যগুলির পুনর্গঠন, সীমানার পুনর্বিন্যাস এবং নেপোলিয়নীয় যুদ্ধের ফলে উদ্ভুত নানা সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মিলিত হয় (১৮১৫ খ্রিঃ)। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের এই সম্মেলন সমগ্র ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন। পোপ ও তুরস্কের সুলতান ছাড়া ইউরোপের সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এই সম্মেলনে যোগ দেন। ইউরোপের সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও নেপোলিয়নের পতনে বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণকারী চারটি রাষ্ট্র– অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, প্রাশিয়া ও ইংল্যান্ড--এই সম্মেলনে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। চার শক্তি ‘চার প্রধান’ বা ‘Big Four’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই চার-শক্তি বাদে সম্মেলনে যোগদানকারী অন্যান্য প্রতিনিধিদের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না- তাঁরা সম্মেলনের ‘শোভাবর্ধনকারী’ ছিলেন মাত্র। এই সম্মেলনের প্রধান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ, রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্যাসলি এবং পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধি তালেরাঁ। সম্মেলনের সভাপতি মেটারনিখ ছিলেন এই সম্মেলনের সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও মূল নিয়ন্ত্রক।

ভিয়েনা সম্মেলনের সমস্যাসমূহ

সম্মেলনের প্রতিনিধিদের সামনে বেশ কিছু জটিল সমস্যা উপস্থিত হয়েছিল। ঐ জটিল সমস্যাগুলির সমাধানই ছিল এই সম্মেলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। সমস্যাগুলি হল- 
  • নেপোলিয়নের আগ্রাসনের ফলে ইউরোপের পরিবর্তিত রাজনৈতিক কাঠামোর পুনর্গঠন। 
  • নেপোলিয়ন কর্তৃক বিতাড়িত পুরোনো রাজবংশগুলির পুনঃপ্রতিষ্ঠা। 
  • ফ্রান্স যাতে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। 
  • নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলির ক্ষতিপূরণ করা এবং ভবিষ্যতে ইউরোপে যাতে শক্তিসাম্য বজায় থাকে তার ব্যবস্থা করা।

ভিয়েনা সম্মেলনের তিনটি মূলনীতি

ইউরোপের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবর্গ প্রধানত তিনটি নীতি গ্রহণ করেন। এই নীতিগুলি হল- ন্যায্য-অধিকার নীতি, ক্ষতিপূরণ নীতি এবং শক্তিসাম্য নীতি।
(1) ন্যায্য অধিকার নীতি: ন্যায্য-অধিকার নীতির মূল উদ্দেশ্যে ছিল ইউরোপে যথাসম্ভব প্রাক-বিপ্লব যুগের পুনঃপ্রবর্তন। এই নীতি অনুসারে ফরাসি বিপ্লবের আগে যে রাজা বা রাজবংশ যেখানে রাজত্ব করতেন সেখানে তাঁকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে ফ্রান্সে বুরবো শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের যে রাজ্যসীমা ছিল তাই তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। স্পেন, সিসিলি ও নেপলস্-এ বুরবো বংশের আরেক শাখা কর্তৃত্ব ফিরে পায়। হল্যান্ডে অরেঞ্জ বংশ, সার্ডিনিয়া ও পিডমন্টে স্যাভয় বংশ এবং মধ্য ইতালিতে পোপের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নীতি অনুসারেই উত্তর ইতালি ও জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা বাহুল্য, এই নীতি কিন্তু সর্বক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হয়নি। ভেনিস ও জেনোয়ায় প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে বিলুপ্ত জার্মান রাজ্যগুলি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়নি সেখানে অস্ট্রিয়ার সভাপতিত্বে ৩৯টি জার্মান রাজ্য নিয়ে একটি ‘বুন্ড’ বা রাজ্য সমবায় গঠিত হয়। বেলজিয়ামকে জোর করে হল্যান্ডের সঙ্গে এবং নরওয়েকে ডেনমার্কের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সুইডেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। সুতরাং ন্যায্য-অধিকার নীতি নয়- নেতৃবর্গ নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিলেন।
(2) ক্ষতিপূরণ নীতি: নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউরোপের বহু রাষ্ট্র, বিশেষত ইংল্যান্ড, ‘রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, সুইডেন প্রভূত ক্ষতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল। ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ক্ষতিপূরণ নীতি অনুসারে তারা বেশ কিছু অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। অস্ট্রিয়া উত্তর ইতালিতে লম্বার্ডি ও ভেনেশিয়া, পোল্যান্ডের অংশবিশেষ, টাইরল ও ইলিরিয়ান প্রদেশগুলি লাভ করে। মধ্য ইতালির পার্মা, মডেনা ও টাস্কেনিতে পুরোনো শাসকদের প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে অস্ট্রিয়ার হ্যাপস্বার্গ বংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া, নবগঠিত জার্মান কনফেডারেশনের নেতৃত্বও অস্ট্রিয়ার হাতে আসে। প্রাশিয়া পায় স্যাক্সনির উত্তরাংশ, পোজেন, থর্ন, ডানজিগ, রাইন অঞ্চল ও পশ্চিম পমেরেনিয়া। রাশিয়া পায় ফিনল্যান্ড, বেসারাবিয়া এবং পোল্যান্ডের বৃহদংশ। এ সময় থেকে ইউরোপীয় রাজনীতিতে বুশ প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ইংল্যান্ড ইউরোপীয় মহাদেশের বাইরে কিছু সামরিক ও বাণিজ্যকেন্দ্র লাভ করে।
(3) শক্তিসাম্য নীতি: শক্তিসাম্য নীতির মূল কথা হল আগামী দিনে ফ্রান্স যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে এবং বিজয়ী শক্তিবর্গের মধ্যে কোন একজন অন্যের চেয়ে যাতে বেশি শক্তিশালী না হয়ে ওঠে, সেদিকে লক্ষ রাখা। এই নীতি অনুসারে ফ্রান্সের সীমানাকে বিপ্লব-পূর্ব সীমারেখায় ঠেলে দেওয়া হয় এবং ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়ে সেখানে পাঁচ বছরের জন্য মিত্রপক্ষের সেনাদল মোতায়েন করা হয়। এছাড়া, ইউরোপের নিরাপত্তার তাগিদে ফ্রান্সের চারপাশে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়। ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে, ফ্রান্সের পূর্ব সীমান্ডে রেনিস প্রদেশ বা রাইন জেলাগুলিকে প্রাশিয়ার সঙ্গে, ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে কয়েকটি জেলাকে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে এবং ফ্রান্সের দক্ষিণে স্যাভয় ও জেনোয়াকে পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত করে ফ্রান্সের চারপাশে একটি শক্তিশালী নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়, যাতে ফ্রান্স কখনই ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে।

ভিয়েনা সম্মেলনের মূল্যায়ন

আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হলেও ভিয়েনা সম্মেলনের কার্যাবলি কিন্তু কখনই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। 
  • ভিয়েনা সম্মেলন নামেমাত্রই ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গের সম্মেলন ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র এই সম্মেলনে যোগ দিলেও অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, প্রাশিয়া ও ফ্রান্স- এই পাঁচটি রাষ্ট্রই ছিল সব। 
  • সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ যুগধর্ম অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত গণতন্ত্র, উদারতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শকে উপেক্ষা করে ইতিহাসের বাতিল হয়ে যাওয়া আদর্শগুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এজন্যই তাঁরা ইতালি, জার্মানি, স্পেন, পোল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য স্থানে প্রস্ফুটিত জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছিলেন। এজন্যই তাঁর হল্যান্ডের সঙ্গে বেলজিয়াম ও নরওয়ের সঙ্গে সুইডেনকে সংযুক্ত করেন, পোল্যান্ডকে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যে বণ্টন করেন এবং ইতালি ও জার্মানির ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভিয়েনা সম্মেলন ছিল প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি নিস্পৃহ। 
  • নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃমণ্ডলী পুরাতনতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন, কিন্তু তাঁদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইউরোপে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের ফলেই ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত ও সংশোধিত হতে শুরু করে।

FAQs on ভিয়েনা সম্মেলন টীকা

ভিয়েনা সম্মেলনের সভাপতি কে ছিলেন?

ভিয়েনা সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর প্রিন্স মেটারনিক।
ভিয়েনা সম্মেলন কবে কোথায় অনুষ্ঠিত হয়?
ভিয়েনা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮১৪ সালের নভেম্বর মাসে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায়।

ভিয়েনা সম্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয়?
ভিয়েনা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮১৪ সালের নভেম্বর মাসে।

ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত নীতি গুলি আলোচনা করো?
নীতি গুলি ছিল ১) ন্যায্য অধিকার নীতি ২) ক্ষতিপূরণ নীতি এবং ৩) শক্তিসাম্য নীতি।

ভিয়েনা সম্মেলন কোথায় হয়েছিল?
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায়।
ভিয়েনা সম্মেলনে ফ্রান্সের প্রতিনিধি কে ছিলেন?
ভিয়েনা কংগ্রেসে ফ্রান্সের প্রতিনিধি ছিলেন ফ্রান্সের প্রতিনিধি ত্যালিরাঁ।

Leave a Comment