মুদ্রণশিল্পের বিকাশে জাপানের অবদান আলোচনা করো

ভূমিকা
পৃথিবীতে মুদ্রণশিল্পের আবির্ভাবের ইতিহাস বহু প্রাচীন। তবে অষ্টম শতাব্দীতে মুদ্রিত বইপত্রের প্রকাশ শুরু হয় চিনে। চিনের কাঠের ব্লক দ্বারা মুদ্রণ পদ্ধতি জাইলোগ্রাফি চিন থেকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি বিশেষ করে জাপানে প্রবেশ করেছিল অষ্টম শতকেই।
(1) জাপানে মুদ্রণের সূত্রপাত: খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে চিনের বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকদের দ্বারা জাপানে চৈনিক মুদ্রণ পদ্ধতির পরিচয় ঘটে। ৭৭০ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ৭৬৪ খ্রিস্টাব্দ) জাপানে ‘হায়াকুমানতো দারানি’ নামে একটি বৌদ্ধ প্রার্থনা গ্রন্থ ছাপা হয়। এটিকেই জাপানের প্রথম মুদ্রিত বই হিসেবে গণ্য করা হয়।
(2) মুদ্রণশিল্পের অগ্রগতি: চিনের মতো কাঠের ব্লকে অক্ষর বা চিত্র খোদাই করে, তাতে কালি মাখিয়ে মুদ্রণ পদ্ধতিই দীর্ঘকাল ধরে চালু ছিল জাপানে। প্রথমদিকে শুধুমাত্র ধর্মীয় গ্রন্থ ছাপা হলেও দ্বাদশ শতকে শোগুনতন্ত্রের শাসন শুরু হওয়ার পর অন্যান্য গ্রন্থও ছাপা হতে থাকে। ‘টেল অফ জেঞ্জি’ (Tale of Genji) নামক উপন্যাস এবং ‘দ্য পিলো বুক’ (The Pillow Book) নামক প্রবন্ধ ও কাব্য সংকলন এক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
(3) সচল হরফ ব্যবহার: ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে, টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের আমলে জাপানে মুদ্রণশিল্পের অগ্রগতি ঘটে। এ সময় সচল হরফ ব্যবহার করে আরও দ্রুত ও বেশি সংখ্যায় বই ছাপা সম্ভব হয়। রঙের ব্যবহার দ্বারা ছবি সম্বলিত বইও ছাপা শুরু হয়।
(4) আধুনিক মুদ্রণ পদ্ধতির প্রবেশ: পশ্চিমি ধাঁচে ধাতব সচল হরফ ব্যবহারের প্রযুক্তি জাপানে নিয়ে আসেন তেনশো ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে, যা কাজে লাগিয়ে ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বই ছাপা হয় নাগাসাকিতে। কিন্তু জাপানি রক্ষণশীল ধর্মীয় ও সামাজিক পরিকাঠামো জাপানে খ্রিস্টান ধর্মকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে সেইসঙ্গে পশ্চিম থেকে নেওয়া মুদ্রণ প্রযুক্তিও বর্জিত হয়।
(5) যন্ত্রনির্ভর মুদ্রণ : আধুনিক যন্ত্রনির্ভর মুদ্রণ জাপানে অনেক দেরিতে প্রচলিত হয়। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম গুটেনবার্গ আবিষ্কৃত মুদ্রণযন্ত্র জাপানে পৌঁছোয় যদিও তার ব্যবহার তেমন প্রচলিত হয়নি। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে জাপানে মেজি প্রত্যাবর্তনের পর থেকে আধুনিক যন্ত্রনির্ভর মুদ্রণ পদ্ধতির বহুল প্রচলন ঘটে।
(6) নিশিকি-ই: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জাপানে কাঠের ব্লকে মুদ্রণ পদ্ধতিতে নতুন সংযোজন হয়। যেখানে একটি ছবিতেই বিভিন্ন রং আলাদা আলাদা ব্লক ও ছাপ দিয়ে রঙিন ছবি ছাপা হত। এই পদ্ধতি নিশিকি-ই (Nishiki-e) নামে পরিচিত।
(7) উকিয়ো-ই: ‘উকিয়ো-ই (Ukiyo-e) শব্দের অর্থ চলমান জীবনের ছবি। টোকুগাওয়া শোগুন যুগে জাপানে কাঠের ব্লক দ্বারা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার যে চিত্র ফুটিয়ে তোলা হত, সেই ধারা উকিয়ো-ই নামে খ্যাত।
মূল্যায়ন
পূর্ব এশিয়ায় মুদ্রণশিল্পের বিকাশে জাপানের মুদ্রণ পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে তার নিজস্ব ঘরানাকে ধরে রাখার কারণে আজও বড়ো বড়ো আধুনিক ছাপাখানা থাকলেও জাপানের ঐতিহ্যবাহী মুদ্রণ পদ্ধতি সেদেশে আলাদাভাবে সমাদৃত।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর