রেনেসাঁ যুগের শিল্পকলার ক্ষেত্রে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর অবদান লেখো

ভূমিকা
মাইকেল অ্যাঞ্জেলো বুওনারোত্তি ছিলেন রেনেসাঁ যুগের প্রখ্যাত শিল্পী। স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রশিল্প-সব ক্ষেত্রেই অতুলনীয় অবদানের জন্য তিনি বিশ্ব শিল্পকলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তাঁর কাজের ধরন এমন ছিল যে, মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত-রংতুলিতে আঁকা ছবি বা প্রাণহীন পাথরের মূর্তি এত প্রাণবন্ত কীভাবে হতে পারে।
(1) ভাস্কর্যশিল্পে অবদান: মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর সৃষ্ট ভাস্কর্যগুলির মূল বৈশিষ্ট্য নিখুঁত আনুপাতিক শারীরিক গঠন ও বাস্তব অভিব্যক্তির প্রকাশ।
- মোজেস: রোমের সান পিয়োত্রোতে ভিনকোলি গির্জায় অবস্থিত, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মোজেস একটি অপূর্ব সৃষ্টি। মারবেল খোদাই করে তৈরি করা মোজেস মাথায় শিং, পেশিবহুল বাহু, দীর্ঘ দাড়ি এবং কুঞ্চিত ভূ নিয়ে এক তীব্র নেতৃত্বদায়ী ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরেছে। এটি রোমে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের সমাধির জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
- ডেভিড: ডেভিড নিঃসন্দেহে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মাস্টারপিস। ১৭ ফুটেরও বেশি লম্বা দৈর্ঘ্যের বাইবেলের চরিত্র ডেভিডের মূর্তিটি মানব সৌন্দর্য্যের প্রতীক। একক মারবেল ব্লক থেকে খোদাই করা মূর্তিটির পেশিবহুল শরীর, তীব্র চোখ এবং নগ্নতা সে যুগের হিসেবে দুঃসাহসী শিল্পসৃষ্টি।
- ‘দ্য পিটা’ বা ‘দ্য পিয়েটা’: ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ভিতরে অবস্থিত একটি অনবদ্য ভাস্কর্য, যেখানে মাতা মেরি ক্রুশবিদ্ধ যিশুর নিষ্প্রাণ দেহটি দু-হাতে ধরে আছেন। মাতা মেরির মুখের দুঃখের ও সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহের অভিব্যক্তি আজও সকলের বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
(2) স্থাপত্যশিল্পে অবদান : মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর স্থাপত্যশিল্পে দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত ‘সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা’ থেকে। যদিও এটির নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু ঘটে এবং আরও অনেক স্থপতির অবদান এটির নির্মাণে রয়েছে, তথাপি প্রধান স্থপতি হিসেবে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো অমর হয়ে আছেন। ফ্লোরেন্সে মেদিচি পরিবারের লরেন্টিয়ান গ্রন্থাগার, ‘পালাজ্জো দে অজারভেটরি’, ‘পালাজ্জো মেনাটেরিও’ ইত্যাদি স্থাপত্য রেনেসাঁ ভাস্কর্যে তাঁর অন্যতম অবদান।
(3) চিত্রশিল্পে অবদান: মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর চিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য এই যে, এগুলিকে ত্রিমাত্রিক বলে মনে হয়।
- দ্য টোর্মেন্ট অফ সেন্ট অ্যান্টান: মাত্র ১২ বা ১৩ বছর বয়সে এই ছবিটি এঁকেছিলেন তিনি যেখানে পৈশাচিক প্রলোভনের বিরুদ্ধে সেন্ট অ্যান্টনির সংগ্রামের এক পরাবাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। চিত্রের চরিত্রগুলির ঘূর্ণায়মান অবস্থান, অন্ধকার আবহে ভীতিকর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে।
- দ্য লাস্ট জাজমেন্ট: রোমের সিস্টিন চ্যাপেলের দেয়ালে আঁকা এই ফ্রেসকোতে তিনি ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা অনুযায়ী ঈশ্বরের শেষ বিচারের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। যিশুর পুনর্জন্ম, পাপীদের নরকে প্রেরণের দৃশ্য, মহাপ্লাবন ও ঈশ্বর কর্তৃক মানুষের পরিত্রাণ-সবই নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে এই বিশাল ফ্রেসকোতে। ৫০০০ বর্গফুটেরও বেশি জায়গা জুড়ে এটি অঙ্কিত।
- দ্য ক্রিয়েশন অফ অ্যাডাম: সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিং-এর ফ্রেসকোতে একটি অংশে ঈশ্বর কর্তৃক অ্যাডামকে প্রাণদানের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন এই ছবিতে। ঈশ্বর ও অ্যাডামের ভিন্ন অবস্থান ও দূর থেকে পরস্পরের আঙুল ছুঁয়ে থাকা-যেন পৃথিবীর ইহজগতের সঙ্গে ঈশ্বরের যোগাযোগের ইঙ্গিত বহন করে। মানবদেহের অঙ্গসংস্থান, পেশি, শিরা, ধমনি সম্পর্কে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর জ্ঞান ছিল যুগের তুলনায় এগিয়ে, যার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর সৃষ্ট চিত্রে। অ্যাডামের অর্ধশায়িত শরীর, মাথা, কনুই ও প্রসারিত হাতের ভঙ্গি এবং ঈশ্বরের করুণাঘন মুখমণ্ডল ও প্রসারিত হাত অবিশ্বাস্য জীবন্ত অনুভূতির সৃষ্টি করেছে।
মূল্যায়ন
মাইকেল অ্যাঞ্জেলো প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য ও স্থাপত্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাই তাঁর ‘ডেভিড’ ও স্থাপত্যকীর্তিগুলি আকারে বৃহৎ। কী চিত্র কী মূর্তিনির্মাণ-বাস্তবধর্মী করার জন্য তিনি গোপনে মৃতদেহ কিনে শবব্যবচ্ছেদ করতেন। ফলে শারীরস্থানের দিক থেকে তাঁর তৈরি মূর্তিগুলি নিখুঁত এবং বিস্ময় সৃষ্টিকারী।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর