র‍্যাগিং ও ছাত্রসমাজ রচনা

র‍্যাগিং ও ছাত্রসমাজ রচনা
র‍্যাগিং ও ছাত্রসমাজ রচনা

ভূমিকা

মানুষ সভ্য হলেও তাদের মনের গহনে লুকিয়ে থাকা যে আদিম ও অশুভ শক্তি, তা-ই র‍্যাগিং-এর মূলে। ‘র‍্যাগিং’ নামক ব্যাপারটি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, সমাজের অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত। আমাদের শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় র‍্যাগিং একটি সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধি আসলে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার। সবলরা দুর্বলের উপর অত্যাচার করে এক ধরনের আনন্দ পায়। মানসিক দিক থেকে র‍্যাগিং করে এক শ্রেণির মানুষ আনন্দ পায়। ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে নবাগতদের উপর প্রাচীনদের ইচ্ছাপূর্বক জোর করে অত্যাচার করে এক ধরনের উল্লাস অনুভব করা-তা মূলত এক ব্যাধির নামান্তর। বলাবাহুল্য যারা প্রথম বছর র‍্যাগিং-এর শিকার, পরের বছর তারাই আবার নবাগতদের র‍্যাগিং করে। এ যেন সেই কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়-বউ অবস্থায় যে মার খায়, শাশুড়ি অবস্থায় সে-ই মার লাগায় বেশি।

র‍্যাগিং কী

র‍্যাগিং হল এক ধরনের অত্যাচারসূচক ক্রিয়াকর্ম। একজন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির উপর কিম্বা একদল ছাত্র অন্য ছাত্রের উপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মৌখিকভাবে অশ্লীল গালিগালাজ করে কিম্বা শারীরিক অত্যাচার করে নিজেদেরকে বীর বলে মনে করে এক ধরনের উল্লাস অনুভব করে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তিগুলি রয়েছে, সেগুলি মাঝে মাঝে অবারিত হয়ে পড়বার অবকাশ খোঁজে। সেইসব আদিম প্রবৃত্তি থেকে উত্তীর্ণ হওয়াই তো পশুত্ব থেকে মানবত্বে উত্তরণের পথ। অথচ মানুষ সেই পশুত্বকে জাগিয়ে তুলে সৃষ্টিসুখের আনন্দে মশগুল হতে চায়। আর এই প্রক্রিয়ার নামই র‍্যাগিং।

র‍্যাগিং-এর প্রকৃতি

সমাজে নানান ধরনের র‍্যাগিং প্রচলিত আছে। যেমন- (১) শিক্ষাক্ষেত্রে বহিরাগত ছাত্রছাত্রীরা যখন ছাত্রাবাসে ভর্তি হয় তখন নবাগতদের উপর প্রবীণ ছাত্রছাত্রীরা এক ধরনের অত্যাচার করে থাকে। (২) সমাজে ‘দাদাগিরি’ এবং ‘নেতাগিরি’ও এক ধরনের র‍্যাগিং। যেমন, রাস্তায় পরিবহণ আটকে চাঁদা তোলা, না দিলে বা চাহিদামতো না দিতে পারলে মারধর করা, জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি। কিম্বা, কোনো নতুন জায়গায় বাড়ি করতে শুরু করলে ক্লাব বা রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কিছু লোক জড়ো করে বেশ কিছু টাকা আদায়ের লক্ষ্যে তার উপর নির্যাতন করা। (৩) রাজনৈতিক র‍্যাগিং। এটি বর্তমানে এই গণতান্ত্রিক দেশে সবচেয়ে বড়ো র‍্যাগিং। কারণ ক্ষমতা দখল করতে গেলে বা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গেলে প্রয়োজন যেন-তেন- প্রকারেণ ভোটবাক্স ঠিক রাখা। (৪) ধর্মীয় র‍্যাগিং। ভারত যেহেতু ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ, তাই ধর্মের নামে সুড়সুড়ি দিয়ে জোর করে ধর্মীয় ভণ্ডামির শিকার করানোর মধ্যে রয়েছে এক প্রকার র‍্যাগিং। মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন সুযোগ বুঝে ধর্মীয় নেতারা তাকে যে ‘ব্ল্যাকমেল’ করেন, তা ধর্মীয় র‍্যাগিং-এর অন্তর্ভুক্ত।

র‍্যাগিং-এর আমদানি

প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে গুরুগৃহ ছিল, ছিল কুলানুগামী শ্রমবিভাগ পদ্ধতি। তাই গুরুগৃহে শিক্ষাদান হত প্রাচীন পদ্ধতিতে, সমাজে শ্রমনীতিও ছিল জন্মসূত্রে। তাই সেক্ষেত্রে র‍্যাগিং-এর সম্ভাবনা ছিল কম। কিন্তু আধুনিক যুগে মানুষ যত পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করল, তখনই র‍্যাগিং নামক বিষয়টি পাশ্চাত্য থেকে আমদানি হতে থাকল। শুরু হল শিক্ষার নামে বর্বরতা, সভ্যতার নামে অসভ্যতা।

সাম্প্রতিক ঘটনা

সম্প্রতি মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে এই র‍্যাগিং-এর ঘটনা বেশি ঘটছে-যা দুর্ভাগ্যজনক। কিছু প্রবীণ ছাত্র নবাগত কিছু ছাত্রের উপর অমানুষিক নির্যাতন করছে, তাতে অনেক ছাত্র কলেজ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে যাঁদের সমাজে খ্যাতি, তাঁরাই যদি এই অমানুষিক কাজের শরিক হয়, তাতে দুঃখ হওয়াই স্বাভাবিক।

র‍্যাগিং-এর কারণ

র‍্যাগিং-এর প্রধান কারণ হল একদল মানুষের বিকৃত মানসিকতা। যে মানসিকতাবশত তাদের নিজেদের চরিত্রকে দিয়ে অপরের চরিত্রকে মূল্যায়ন করে। এই বিকৃত মানসিকতা জন্মে প্রাচুর্যের মধ্যে থেকে অথবা যথার্থ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে। যারা প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হয়, জগৎ ও জীবনে নানান সমস্যার সম্মুখীন হয় না, বাবা-মার অতিরিক্ত আদরে বাঁদর তৈরি হয়েছে, তারাই র‍্যাগিং-এ মদত দেয় বা ঐ কাজে নিয়োজিত হয়। অথবা যারা দীর্ঘদিন ধরে স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে অবহেলার শিকার হয়েছে, তারাও এই ধরনের কাজ করে নিজেদের জ্বালা মেটাতে চায়। অপরকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়া-এ এক বিকৃত মানসিকতা। যে মানসিকতা থেকে জন্ম নেয় র‍্যাগিং।

প্রতিকার

প্রতিকার মূলত মানসিকতার পরিবর্তনে, বিকৃত মানসিকতার বিসর্জনে। যে র‍্যাগিং করবে সে যদি ভাবে আমি যার উপর র‍্যাগিং করছি, সেও আমার মতো একজন মানুষ, তখন সে অমানুষিক অত্যাচার করতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে। দ্বিতীয়ত, ছাত্রাবাসগুলিতে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করা এবং প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত, র‍্যাগিংকারীদের জন্য কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করা, যাতে সে এ ধরনের কাজ করতে সাহস না পায়। চতুর্থত, অপরকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়ার যে আদিম প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে রয়েছে, সেটিকেও মন থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। সর্বোপরি অভিভাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও শিক্ষক শিক্ষিকাদের উচিত ছেলেমেয়েদের কাউন্সেলিং করা-যাতে তারা এই ধরনের বিকৃত মানসিকতা থেকে দূরে থাকে। পঞ্চমত, ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে হবে তাদের সহপাঠীরা তাদেরই পরিবারের একজন। তারাও কোন এক প্রতিবেশী, শত্রু নয়।

উপসংহার

শিব গড়তে গিয়ে যেমন বাঁদর গড়া, তেমনি আলাপ করতে গিয়ে র‍্যাগিং করা-এ কাজ সমর্থনযোগ্য নয়। সদিচ্ছা যদি থাকে, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যদি থাকে তাহলে নতুনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার নানা পথ আছে, তার জন্য র‍্যাগিং করতে হবে কেন? আসলে শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, সমাজের সর্বক্ষেত্রে এই র‍্যাগিং-এর প্রকোপ দূর করতে হলে চাই আপামর জনসাধারণের দৃঢ় মানসিকতা ও প্রতিবাদী চেতনা। বর্তমানে মূলত সরকারি ও বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে র‍্যাগিং-এর প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে-এটা চিন্তার কারণ বৈ কি।

Leave a Comment