শিল্প সমাজের সমাজতান্ত্রিক সমালোচনা

শিল্প সমাজের সমাজতান্ত্রিক সমালোচনা
শিল্প সমাজের সমাজতান্ত্রিক সমালোচনা

শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভব

শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে কলকারখানা গড়ে উঠতে থাকে। আবার অনেক সময় এইসব কলকারখানাকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ডে বিভিন্ন শহর গড়ে ওঠে। শ্রমিকরাই ছিল কারখানার প্রাণ। তাদের শ্রমের দ্বারাই পণ্যাদি উৎপন্ন হত এবং মালিকরা মুনাফা অর্জন করত। এ সত্ত্বেও শ্রমিকদের মজুরি ছিল খুবই কম। তাদের চাকরির কোনো নিশ্চয়তা ছিল না- মালিকরা যে কোনো সময় তাদের ছাঁটাই করত। তাদের কাজের কোনো বাঁধা-ধরা সময় ছিল না। কারখানার অপরিচ্ছন্ন ও আলো-বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হত। নারী ও শিশুদের নামমাত্র মজুরিতে কলকারখানা ও খনিতে বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত করা হত। কঠোর পরিশ্রম ও অনাহারের ফলে বহু শিশু-শ্রমিক অকালে প্রাণ হারাত। কারখানার পাশেই অতি অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা বস্তিতে নানারকম রোগ-মহামারীকে সঙ্গী করে তারা বাস করত। বিশুদ্ধ পানীয় জল বা পর্যাপ্ত জলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, মদ্যপান, নৈতিক স্খলনই ছিল তাদের স্বাভাবিক জীবন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যক্ষ্মা, বসন্ত, কলেরা বা টাইফয়েডে তারা অকালে প্রাণ হারাত। শ্রমিকরা তাদের এই শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। কাজের সময় হ্রাস ও অধিক মজুরির দাবি এবং অপরাপর শোচনীয় অবস্থা থেকে মুক্তির আশায় তারা সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়। এভাবেই জন্ম নেয় শ্রমিক আন্দোলন।

সমাজতন্ত্রের উদ্ভব

শিল্পবিপ্লব-জনিত কারখানা প্রথার ত্রুটি দূর করার জন্যই আধুনিকযুগে সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব। শিল্প বিপ্লবের ফলে দেশে দেশে জাতীয় সম্পদ প্রভৃত পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং এই সম্পদ মুষ্টিমেয় শিল্পপতি ও পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। যাদের শ্রমে এই সম্পদের সৃষ্টি, সেই শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রবল দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাতে থাকে। এর ফলে পুঁজিপতি ও শ্রমিক বা শ্রমিক-মালিক দ্বন্দু অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই দ্বন্দ্বের সমাধানের জন্যই উদ্ভব হয় সমাজতন্ত্রবাদের। তাই বলা যায় যে, সমাজতন্ত্রবাদ হল ধনতন্ত্রবাদ বা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দরিদ্রশ্রেণির প্রতিবাদ বা মালিকশ্রেণি কর্তৃক শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

প্রথম যুগের সমাজতন্ত্রীগণ

অষ্টাদশ শতকের শেষ ও উনিশ শতকের সূচনায় সমাজতান্ত্রিক ধারণা স্পষ্ট রূপ নিতে থাকে। এই যুগে সমাজতন্ত্রের আদি উদ্‌দ্গাতাদের মধ্যে রবার্ট আওয়েন, হেনরি সেন্ট সাইমন, চার্লস ফুরিয়ার, লুই ব্ল‍্যাঙ্ক, প্রুধোঁ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ছিলেন। এইসব দার্শনিকরা শোষণের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কথা বললেও, সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য কোনো বাস্তব পথের সন্ধান দিতে পারেননি। তাই কার্ল মার্কস ও তাঁর অনুগামীরা এইসব চিন্তাবিদকে ‘ইউটোপিয়ান’ বা ‘অবাস্তব’ বা ‘স্বপ্নবিলাসী সমাজতন্ত্রী ‘বলে আখ্যায়িত করেছেন।

রবার্ট আওয়েন (১৭৭১-১৮৫৮ খ্রিঃ) ‘ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রের জনক’ নামে পরিচিত। তিনিই সর্বপ্রথম ‘সমাজতন্ত্রবাদ’ কথাটি প্রচলন করেন। তাঁর রচিত ‘নিউ ভিউ অব সোসাইটি’ এবং’ রিপোর্ট টু দ্য কাউন্টি অফ ল্যানার্ক’ নামক দুটি গ্রন্থে তিনি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নতুন পথের সন্ধান দেন। নিজে একজন শিল্পপতি হয়েও তিনি শ্রমিক কল্যাণের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নিউ ল্যানার্ক শহরে একটি আদর্শ কারখানা প্রতিষ্ঠা করে তিনি সকলকে দেখাতে চান যে, মালিকদের স্বার্থ ক্ষুন্ন না করেও শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া যায়। এখানে তিনি শ্রমিকদের জন্য উন্নত পরিবেশ, ভাল বিদ্যালয়, সমবায় বিপণি এবং বৃদ্ধ বয়স বা অসুস্থ অবস্থায় পেনসনের ব্যবস্থা চালু করেন। তিনি মনে করেছিলেন যে, অন্যান্য শিল্পপতিগণও তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

হেনরি সেন্ট সাইমন [Henri de Saint-Simon]

হেনরি সেন্ট সাইমন (১৭৬০-১৮২৫ খ্রিঃ) ‘ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রবাদের আদি গুরু’ হিসেবে পরিচিত। তাঁকে ‘ফরাসি সমাজতন্ত্রের জনক’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। ‘নব খ্রিস্টবাদ’ গ্রন্থে তাঁর মতবাদ বিবৃত হয়েছে। তাঁর মতে ধন বণ্টনের অসাম্যের জন্যই সমাজ ধনী ও দরিদ্র- দুই শ্রেণিতে বিভক্ত হয়েছে। ধনীরা দরিদ্রদের শোষণ করে, তাই সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন বাতিল হওয়া উচিত। তিনি মনে করতেন যে, শিক্ষা ও নীতিবোধের বিস্তার হলেই শিক্ষিতশ্রেণি দরিদ্রদের উন্নতির জন্য চেষ্টা করবে। তিনি শ্রমিক-মালিক সহযোগিতা ও সমবায়ের ভিত্তিতে শিল্প-রাষ্ট্র গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম এই মতবাদ প্রচার করেন যে, প্রত্যেক মানুষ তার ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং রাষ্ট্র তার প্রয়োজন মেটাবে। তাঁর মতবাদের মূল কথা হল অর্থনৈতিক সাম্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত স্বার্থশূন্য ও প্রতিযোগিতাহীন একটি সমাজ গঠন করা।

চার্লস ফুরিয়ার [Charles Fourier]

চার্লস ফুরিয়ার (১৭৭২-১৮৩৭ খ্রিঃ) ছিলেন সেন্ট সাইমনের মন্ত্রশিষ্য। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এবং এর অবসানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি এমন এক সমাজের কল্পনা করেন যার ভিত্তি ছিল ‘কমিউন’। ১৫০০ থেকে ২০০০ নারী-পুরুষ নিয়ে এক একটি কমিউন গড়ে উঠবে। প্রত্যেকে সেখানে নিজ নিজ সামর্থ্য ও রুচি অনুযায়ী কাজ করে খাদ্য-বস্ত্র উৎপাদন করবে এবং নিজেরাই তা ভাগ করে নেবে। এখানে মজুরি, মুনাফা ও প্রতিযোগিতা বলে কিছু থাকবে না। রাষ্ট্রীয় দমনমূলক প্রতিষ্ঠান পুলিশ, কারাগার সবই বিলুপ্ত হবে। এখানে সব মানুষই হবে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী। তাঁর মতবাদ ইউরোপ ও আমেরিকায় বেশ জনপ্রিয় হয় এবং তাঁর অনুগামীরা বেশ কয়েকটি ‘কমিউন’ গড়ে তোলেন।

ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস্ ও কার্ল মার্কস-এর সমালোচনা

আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের জনক কার্ল হাইনরিখ মার্কস (১৮১৮-৮৩ খ্রিঃ) ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মে জার্মানির ট্রিয়ার শহরে এক মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবাদের জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী ছাত্র কার্ল মার্কস বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে লেখাপড়া করলেও ইতিহাস ও দর্শনশাস্ত্রে তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ও ব্যুৎপত্তি ছিল। প্যারিসে অবস্থানকালে বিশিষ্ট সমাজতন্ত্রী চিন্তাবিদদের সান্নিধ্যে এসে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি তাঁর বিশ্বাস সুদৃঢ় হয়। এখানেই বিশিষ্ট বন্ধু ও সহযোগী ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস (১৮২০-৯৫ খ্রিঃ)-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এই বন্ধুত্ব সারা জীবন অটুট ছিল। তাঁরা যৌথভাবে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক দর্শনকে সর্বসমক্ষে উপস্থাপিত করেন এবং সর্বপ্রকার অ-বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক মতবাদকে খণ্ডন করেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সংস্থার মাধ্যমে তাঁদের বৈপ্লবিক মতবাদ ও বিপ্লবী তত্ত্ব প্রকাশিত হতে থাকে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ বা ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এই ইস্তাহারই হল আধুনিক সমাজতন্ত্রের প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা- ‘The birth-cry of modern Socialism’। ইস্তাহারের প্রথম কথাই হল- “মানব সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণি সংগ্রামের নামান্তর মাত্র”। এই পুস্তিকার মাধ্যমে ধনতন্ত্র বিনাশের অনিবার্যতা ও শ্রেণি-সংগ্রাম তত্ত্ব ঘোষিত হয় এবং বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবন্ধ হয়ে ইতিহাস-নির্দিষ্ট পথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়। ইস্তাহারে প্রকাশিত সমাজতন্ত্রবাদী তত্ত্বই ‘ডাস ক্যাপিটাল’গ্রন্থে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, পূর্বতন সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে নিজ মতবাদের পার্থক্য বোঝানোর জন্য কার্ল মার্কস ‘সমাজতন্ত্র’ (Socialism) কথাটির পরিবর্তে ‘কমিউনিজম’ (Communism) শব্দটি ব্যবহার করেন। কার্ল মার্কস প্রচারিত মতবাদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ, সাম্যবাদ বা মার্কসবাদ নামে পরিচিত।

ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা

তিনি ইতিহাসের এক নতুন বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর এই ব্যাখ্যা ‘ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা’, ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ এবং ‘অর্থনৈতিক নিমিত্তবাদ’ নামে পরিচিত। তাঁর মতে যুদ্ধ, রাজনৈতিক ঘটনা বা মহাপুরুষদের কর্মকাণ্ড ইতিহাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করে না। একটি দেশের ইতিহাস, সমাজ, সভ্যতা, নৈতিকতা, শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম- সব কিছুর মূল প্রেরণা বা নিয়ন্ত্রক হল অর্থনীতি। উৎপাদন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই ইতিহাসের গতি আবর্তিত হয়। তাঁর মতে, মানব সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণি-সংগ্রামের নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাস। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এই শ্রেণি-সংগ্রাম বা দ্বন্দু চলছে। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে ক্রীতদাস ও স্বাধীন নাগরিক, প্রাচীন রোমে অভিজাত ও সাধারণ নাগরিক, মধ্যযুগে ভূমিদাস ও সামন্তপ্রভু এবং আধুনিক যুগে শ্রমিকশ্রেণি ও পুঁজিপতিদের দ্বন্দ্ব হল সেই নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়। তাঁর বিশ্বাস আধুনিক যুগের এই সংগ্রামে বিশ্বের সব মেহনতী মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণির জয় হবেই এবং তাঁরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠা করবে। এইভাবে গড়ে উঠবে এক শ্রেণিহীন সমাজ- যেখানে কোনো অত্যাচার ও শোষণ থাকবে না এবং এর ফলে রাষ্ট্রেরও কোনো প্রয়োজন থাকবে না। তাই বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির কাছে তাঁর আহ্বান- “দুনিয়ার মজদুর এক হও”। তিনি বলছেন, “সাম্যবাদী বিপ্লবের ভয়ে শাসকশ্রেণি কেঁপে উঠুক। দাসত্বের শৃঙ্খল ছাড়া শ্রমিকশ্রেণির হারাবার আর কিছুই নেই। জয় করার জন্য তাদের সামনে আছে সারা বিশ্ব”।

গুরুত্ব

নানা ত্রুটি সত্ত্বেও মার্কসবাদের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। সারা বিশ্বে মার্কসবাদ এক যুগান্তকারী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। শিল্প বিপ্লব-প্রসূত ‘ফ্যাক্টরি প্রথা’-র ফলে শিল্পপতিদের অত্যাচারে শ্রমিকদের অবস্থা যখন শোচনীয়, তখন কার্ল মার্কস তাঁর প্রচারের দ্বারা বিশ্ববাসীকে শ্রমিকের দূরবস্থা সম্পর্কে সচেতন করেন। তাঁর প্রচারকার্যের ফলে শ্রমিকদের মধ্যেও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। সাম্যবাদী মতাদর্শের প্রভাব থেকে শ্রমিকশ্রেণিকে দূরে সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ইউরোপে বহু দেশে জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে সমাজতান্ত্রিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াতে সমাজবাদের প্রতিষ্ঠা ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে।

Leave a Comment