![]() |
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় নিষ্কাম কর্মের বিষয়টিকে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করো |
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় নিষ্কাম কর্ম
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাই হল নিষ্কাম কর্মের প্রকৃত প্রচারক্ষেত্র। সাধারণত গীতাকে আমরা একটি ধর্মগ্রন্থরূপে উল্লেখ করি। কিন্তু গীতা শুধু একটি ধর্মগ্রন্থই নয়, তা একটি অন্যতম নীতিশাস্ত্রও। এখানে ধর্ম ও নীতি এতই ঘনিষ্ঠভাবে মিশে গেছে যে, একটিকে ছেড়ে অন্যটিকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ধর্ম এখানে পূর্ণতালাভ করেছে নৈতিকতার পটভূমিতে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীকৃয় অর্জুনকে তার ক্ষাত্রধর্ম রক্ষার্থে কুরুক্ষেত্র নামক ধর্মযুদ্ধে প্রোৎসাহিত করেছেন বিভিন্নরকম নৈতিক উপদেশাবলির মাধ্যমে। এই উপদেশাবলির গূঢ় নিহিতার্থ হল-নিষ্কামভাবে কর্ম করা এবং শ্রীভগবানে সমর্পিত চিত্ত হওয়া। ভারতীয় দর্শন, নীতিশাস্ত্র এবং ধর্মশাস্ত্রগুলিতে নিষ্কাম কর্মের ওপরই সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এরূপ কর্মকেই উচ্চস্তরের কর্মরূপে বন্দনা করা হয়েছে। এরূপ কর্মই মানুষের আধ্যাত্মিক উপলব্ধির সহায়ক-যা মানুষকে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভে ধন্য করে। গীতায় যেহেতু নিষ্কাম কর্মের সর্বাধিক প্রচার দেখা যায়, সেহেতু নিষ্কাম কর্মের তত্ত্বটিকে যথাযথভাবে অনুধাবন করতে হলে, কুরুক্ষেত্র নামক ধর্মযুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি ও তার প্রেক্ষাপটটি সঠিকভাবে – অনুধাবন করা প্রয়োজন।
ধর্মযুদ্ধের প্রয়াসে নিষ্কাম কর্ম
মহাভারতের বাহ্যিক প্রেক্ষাপটটি হল কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ। যুদ্ধে অবতীর্ণ উভয়পক্ষই হল একই বংশোদ্ভূত। কুরুপক্ষ তথা কৌরবপক্ষ এবং পাণ্ডবপক্ষ-উভয়ই যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও, তারা আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। রাজদণ্ডের অধিকার নিয়ে যুদ্ধের বাহ্যিক প্রেক্ষাপটটি রচিত হলেও, তার অন্তর্নিহিত প্রেক্ষাপটটি অত্যন্ত গভীর ও সংবেদনশীল। এই অন্তর্নিহিত প্রেক্ষাপটটি হল-অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের যুদ্ধ। সেকারণেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধরূপে উল্লেখ করা হয়। এক্ষেত্রে কৌরবপক্ষ হলেন অধর্মের তথা অন্যায়ের প্রতীক, আর পাণ্ডবপক্ষ হলেন- ন্যায় তথা ধর্মের প্রতীক। এরূপ ধর্মযুদ্ধের প্রধান সৈনিক হলেন, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন এবং ভগবান শ্রীকৃয় হলেন তাঁর সারথি। তিনি শুধু অর্জুনের যুদ্ধরথের সারথিই নন, তিনি হলেন অর্জুনের জীবনরথেরও সারথি। তিনি তাই অর্জুনকে – বারবার ন্যায়ের পথে চলার উপদেশ দিয়েছেন। নৈতিকতার আদর্শ ও মহিমাকে তিনি অর্জুনের মনে প্রোথিত করতে চেয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি অর্জুনকে নিষ্কামভাবে কর্ম করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
নিমিত্ততায় নিষ্কাম কর্ম
গীতার সূচনা হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে উপনীত অর্জুনের বিষাদের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধের প্রারম্ভেই তিনি উভয়পক্ষের সেনানীদের পর্যবেক্ষণ করে, আত্মীয়বধে ভীত হলেন এবং গাণ্ডীব পরিত্যাগ করে যুদ্ধ না-করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ যাবৎ অর্জুনের সমস্ত ক্রিয়াকলাপই সকামরূপে গণ্য। কারণ, এর মূলে রয়েছে অর্জুনের অজ্ঞতা। এরূপ অজ্ঞতার বশবর্তী হয়েই অর্জুন তাঁর সমস্ত কর্মের নিয়ামক বলে নিজেকে মনে করলেন। কিন্তু বিষয়টি যে তা ঠিক নয়, তা শ্রীকৃয় অর্জুনকে বারেবারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি অর্জুনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্ত ঘটনাই পূর্বনির্ধারিত এবং অর্জুন তার নিমিত্তমাত্র। এরূপ বিষয়টিকে অনুধাবন করেই অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃয় যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন এবং নিষ্কামভাবে কর্ম করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এরূপ বিষয়টির মধ্যেই নিষ্কাম কর্মের বীজটি নিহিত।
দৃঢ়চেতায় নিষ্কাম কর্ম
নিষ্কাম কর্মের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হল-কর্মকর্তা তার কৃতকর্মজনিত সুখদুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, স্তুতি-নিন্দা, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয়-সমস্ত কিছুতেই যেমন নিরুদ্বিগ্ন থাকবেন, তেমনই কর্মফল সম্পর্কেও উদাসীন থাকবেন। কর্মকর্তাকে বিষাদ-আনন্দ, কাম-ক্রোধ এবং লজ্জা-ভয় প্রভৃতিকে জয় করে দৃঢ়চেতা হতে হবে। যিনি নৈতিকভাবে এরূপ দৃঢ়চেতা ব্যক্তি, একমাত্র তিনিই নিষ্কামভাবে কর্ম সম্পাদনে সমর্থ। একমাত্র এরূপ ব্যক্তিই জগতের মঙ্গলসাধনে সমর্থ।
দৌর্বল্যত্যাগে নিষ্কাম কর্ম
নিষ্কামভাবে কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে দুর্বলচেতা ব্যক্তির কোনো স্থানই নেই। কারণ, দুর্বলচেতা ব্যক্তি কখনোই সমাজের সামগ্রিক মঙ্গলসাধন করতে পারে না। নিষ্কাম কর্মের পথযাত্রীকে তাই সমস্তপ্রকার দুর্বলতা পরিত্যাগ করতে হয় এবং দৃঢ়চেতারূপে গণ্য হতে হয়। এরূপ ব্যক্তিকেই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যোগীরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। যাঁরা প্রকৃত যোগী-শুধু তাঁরাই ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যের অধিকারী। তাঁরা মানসিক পবিত্রতায় ভরপুর, অন্তরের শুচিতায় স্নিগ্ধ এবং অবশ্যই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারী। ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠতা, মানসিক পবিত্রতা, অন্তরের শুচিতা, আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এবং সমগ্র জগতের মঙ্গলসাধনের ব্রত-প্রভৃতি হল নিষ্কাম কর্মের পূর্বশর্ত বা স্বীকার্য সত্য। গীতার মতে, নিষ্কামযোগী তাই একাধারে নিষ্কাম কর্মী, আত্মজ্ঞানী এবং ঈশ্বরে সমর্পিত পরমভক্তরূপে গণ্য হবেন।