![]() |
সমাজের কল্যাণ সাধনে ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা রচনা |
ভূমিকা
‘আমরা শক্তি আমরা বল/আমরা ছাত্রদল।/মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান/উর্ধ্বে বিমান ঝড় বাদল’। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে গেয়েছিলেন কবি এই ভেবে যে- ছাত্ররা দুর্বার প্রাণশক্তির আধার। তাদের লক্ষ্য নির্দিষ্ট, হৃদয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী সাহস, কর্মে তাদের নিরলস অবিশ্রাম গতি। দুর্গম গিরি, কান্তার মরু ছাত্রদের কাছে কোনো বাধা নয়, অফুরন্ত তাদের প্রাণশক্তি। এই অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ছাত্ররা যদি লেখাপড়া বজায় রেখেও মানব সেবায়, সমাজের কল্যাণে তথা সমাজগঠনে নিজেদের নিয়োজিত করে তাহলে দেশ ও জাতির উন্নতি অবধারিত।
ছাত্রদের স্বভাব বৈশিষ্ট্য
স্বভাবে বন্ধনহীনতা, চরিত্রধর্মে এগিয়ে চলা, প্রথা ও কুসংস্কারের জগদ্দল পাথর সরিয়ে দিয়ে গতিময় জীবনের স্রোতকে প্রবাহিত করে দেওয়া ছাত্রদের অফুরান প্রাণের বৈশিষ্ট্য। শুষ্ক ও মিথ্যা আচারের শৈবালে রুদ্ধগতি নদীর মতো গতিহীন সমাজে আদর্শায়িত কর্মচাঞ্চল্যের প্রাণধারা প্রবাহিত করতে পারে ছাত্রসমাজ। সার্বিক ও সামাজিক কল্যাণের মন্ত্রে তারা দীক্ষিত। পুরাতন সব কিছুকে নির্বিবাদে মেনে নেওয়া নয়, যুক্তির দ্বারা বিচার করে গ্রহণ করা হল ছাত্রদের বৈশিষ্ট্য। কিশোর ছাত্র বিশেষ করে তাদের কৈশোর বয়সটা একটা ঝড় ও ঝঞ্ঝার কাল। সেই সময়ে তাদের প্রশস্ত উদার হৃদয় নতুন কিছু করতে চায়, করে দেখাতে চায়।
সমাজের প্রতি কর্তব্য
নবজাত শিশু দুটি সত্তা বহন করে আনে-একদিকে ব্যক্তিসত্তা অন্যদিকে সমাজসত্তা। সেই শিশুর নগ্নতা ঢাকবার জন্য সমাজ এগিয়ে আসে বস্ত্র হাতে, উৎপাদন করে খাদ্য ও বানিয়ে নেয় বাসস্থান। সমাজের অস্তিত্ব নির্ভর করে পারস্পরিক দেওয়া- নেওয়ার উপর। সমাজ থেকে শুধু গ্রহণ করব, সমাজকে কিছু দেব না-এই নিয়ম সমাজে চলতে পারে না। সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে সমাজের কাছে আজন্ম-প্রাপ্ত সমস্ত ঋণ শোধ করতে হয়। ছাত্রছাত্রীদের মনে রাখতে হবে, লেখাপড়া করে শুধু ক্যারিয়ারিস্ট হলেই তাদের কাজ শেষ হয়ে যায় না, তাদেরও সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। সমাজ উন্নয়নের মতো বিস্তৃত ও উজ্জ্বল লক্ষ্যে প্রণোদিত হয়ে আর্ত মানুষের জন্য কিছু করা অর্থাৎ সমাজসে বা করাই হল সমাজের ঋণশোধের উৎকৃষ্ট পথ। আবার ব্যক্তির এই সামাজিক সত্তা সমাজের প্রতি একনিষ্ঠ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই বিকশিত হয়, চরিত্রে আসে সংহতির ভারসাম্য।
কর্তব্য ও সম্মানবোধ
ছাত্রসমাজ নিজেরা যদি কর্তব্যবোধে সচেতন হয়, তারা যদি নিজেদেরকে একজন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাহলে তাদের অনেক কিছুই করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা। সচেতনতাই পারে যে কোনো লক্ষ্যকে সার্থক করতে। তাই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও সরকারের উচিত ছাত্রদের মানসিকতার মধ্যে সমাজসেবার গঠনমূলক দিকটিকে তুলে ধরা ও তাদের এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা। শুধু নিজেদের ক্যারিয়ার গঠন নয়; শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া কিংবা বড়ো পদে চাকরি করা নয়, সমাজের প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা সকলের আছে-এ কথা ছাত্রদেরকে বোঝানো উচিত। আজকের ছাত্ররা যে স্বার্থপর মনোবৃত্তির শিকার হচ্ছে, কিংবা নিঃসঙ্গতার বলি হচ্ছে তার অন্যতম কারণ ছাত্ররা এই সমাজের দায়বদ্ধতা থেকে পিছিয়ে পড়ছে বলেই, জনসংযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলেই। শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলে হবে না; যেখানে প্রতিষ্ঠিত হব, যাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হব, তারা যদি মনে-প্রাণে তাদের প্রতিষ্ঠা না দেয়, অন্তরে অন্তরে একটা দূরত্ব বজায় রাখে তাহলে ছাত্রদের তথাকথিত প্রতিষ্ঠা লাভের অর্থ অর্থহীন হয়ে পড়ে। এজন্য প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা। একজন ছাত্র তার বন্ধুর বই চাইলে সে যেন না বলে যে তার মা দিতে বারণ করেছে। তাহলে তো মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের দেশে যেখানে এখনো মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত, সরকারি সুফল যেখানে গুটি কয়েক মানুষের করায়ত্ত, প্রশাসকরা সাধারণের অসচেতনতার কারণে তাদের শাসনযন্ত্রকে কায়েম রাখছে সেখানে কর্তব্য-সচেতন নাগরিক হিসেবে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকে না। ছাত্রসমাজ তথা যুবসমাজকে পিছিয়ে রেখে, মানব কল্যাণে উদ্বুদ্ধ না করে দেশের অগ্রগতি এলে তাও হবে ব্যর্থ।
কর্মপন্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা
লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে প্রথমেই প্রয়োজন নির্দিষ্ট কর্মপন্থার। শুধু বস্তাপচা কিছু তত্ত্ব ছাত্রদের মাথায় ঢোকালে এবং ছাত্ররা সেগুলি মুখস্থ করে বেশি নম্বর পেলেই চলবে না, তারা যথার্থ মানুষ হয়ে উঠছে কিনা, তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা গড়ে উঠেছে কি না-সেটা দেখাও জরুরি। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু সংস্কার প্রয়োজন। প্রয়োজন সুস্থ, সবল, সরল, উদার মানসিকতার। সমাজসেবা যেহেতু মানুষের অন্তর্নিহিত মানবতার মৌলিক প্রকাশ ও সহজাত প্রবৃত্তি, সেহেতু তা কেবলমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়েই গড়ে তোলা যায় না। সমাজসেবীরা গড়ে ওঠেন না, সমাজসেবী হয়ে ওঠার ক্ষমতা সহজাত। তাই তাদের অন্তরে কিছু প্রেরণা ও সম্ভাবনা থাকা দরকার, দরকার উপযুক্ত মানসিকতার। কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী কর্মসূচি গ্রহণ ও তার মূল্যায়ন প্রয়োজন। শুধু এন. এস. এস. বা এন. সি. সি. করলেই হবে না, একজন সমাজসেবক ও দেশরক্ষাকারী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে গেলে চাই যথার্থ লক্ষ্য ও মানসিকতা এবং সেই মানসিকতার উপযুক্ত লালন।
উপসংহার
শিক্ষার লক্ষ্যের অন্যতম দিক হল সমাজের সঙ্গে তার সাযুজ্য ও সংগতি স্থাপন। জীবনের সামগ্রিক দিকের উন্মোচন হল শিক্ষার লক্ষ্য। স্বামীজি তাই বলেছেন, শিক্ষা হল মানবের অন্তর্নিহিত সত্তার জাগরণ-যা সমাজসেবার মাধ্যমে ঘটতে পারে। তাই ছাত্রসমাজকে শুধু পুঁথিগত শিক্ষা দিয়ে নয়, সত্যিকারের মানুষ করে গড়ে তুলতে গেলে সমাজসেবার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।