সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা – ১৯১২ সাল নাগাদ হেমচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ঢাকাতে একটি বিপ্লবী দল প্রতিষ্ঠিত হয়। এর কোনো নাম ছিল না। পরবর্তীকালে সরকারি রিপোর্টে এই দলকে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ (বি.ভি.) নামে অভিহিত করা হয়।
তো চলুন আজকের মূল বিষয় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা পড়ে নেওয়া যাক।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা
![]() |
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা
|
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা
বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। বিপ্লবী নেতাদেরও লক্ষ্য ছিল ছাত্র সমাজ- যেভাবেই হোক তাদের মধ্যে যোগ্য ও বিশ্বস্তদের আন্দোলনের মধ্যে টেনে আনতে হবে। এই উদ্দেশ্যে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ ব্যায়ামাগার, আখড়া, ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে ছাত্রদের আকৃষ্ট করতেন। ‘সিডিসন কমিটি’ (Sedition committee)-র রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বিপ্লবী দলের লোকেরা গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও হোস্টেলে প্রচার চালিয়ে ছাত্রদের দলভুক্ত করার চেষ্টা করতেন। এই রিপোর্টে দুটি ‘জাতীয় বিদ্যালয়’-এর কথা বলা হয়েছে, যারা সরকারের চোখে খুবই কুখ্যাত’ ছিল। একটি হল ‘ঢাকা ন্যাশনাল স্কুল’ এবং অন্যটি ‘সোনারং ন্যাশনাল স্কুল’। এই বিদ্যালয় দুটি সভ্য-সংগ্রহ এবং তাদের শিক্ষাদানের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। ‘সিডিসন কমিটি’-র রিপোর্টে বিশেষভাবে এই দুটি স্কুল এবং অন্যান্য স্কুলের কথা বলা হয়েছে।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স
বিশ শতকের সূচনা থেকে ঢাকা বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থানে পরিণত হয়। ১৯১২ সাল নাগাদ হেমচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ঢাকাতে একটি বিপ্লবী দল প্রতিষ্ঠিত হয়। এর কোনো নাম ছিল না। পরবর্তীকালে সরকারি রিপোর্টে এই দলকে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ (বি.ভি.) নামে অভিহিত করা হয়। ১৯২৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনকালে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। এর অন্যতম সংগঠক ছিলেন এই দলের সত্য গুপ্ত। সম্ভবতঃ এ থেকেই এই নামকরণ হয়েছে। হেমচন্দ্র ঘোষ এই দলের সর্বময় কর্তা হলেও যৌথ-নেতৃত্বে এই দল পরিচালিত হত। এই দলের অন্যান্য নেতারা হলেন হরিদাস দত্ত, সুপতি রায়, জ্যোতিষ জোয়ারদার প্রমুখ। বাংলার বিভিন্ন জেলায় এর শাখা গড়ে ওঠে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রাইটার্স বিল্ডিংস্ আক্রমণকারীদের অন্যতম দীনেশ গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত মেদিনীপুর শাখা। এই দলের বিশিষ্ট কর্মী-শহীদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাইটার্স বিল্ডিংস আক্রমণকারী বিনয় বসু, সুধীর গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্ত। মেদিনীপুর জেলা শাসক ডগলাস হত্যাকারী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, বার্জ হত্যাকারী অনাথ পাঁজা, মৃগেন দত্ত, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃয় রায় প্রমুখ বিপ্লবীরা এই দলের সদস্য ছিলেন।
সূর্য সেন (১৮৯৪-১৯৩৪ খ্রিঃ)
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে অসমসাহসী ৬৫ জন তরুণ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ লাইন ধ্বংস করে চট্টগ্রামে এক স্বাধীন ‘বিপ্লবী সরকার’ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। পরে সামরিক বাহিনী চট্টগ্রামে প্রবেশ করলে বিপ্লবীরা নিকটস্থ জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। সেখানে দু’পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই অসম যুদ্ধে বেশ কিছু বিপ্লবী নিহত হন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিপ্লবীরা চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসন বিপর্যস্ত করে দেন। পরে বিপ্লবী নায়ক সূর্য সেন ধরা পড়েন এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয় (১৯৩৪ খ্রিঃ)। স্কুল শিক্ষক সূর্য সেন সাধারণের কাছে ‘মাস্টার দা’ নামে পরিচিত ছিলেন। ‘চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস’-এর সভাপতি ‘মাস্টার দা’-র মধ্যে বিপ্লবী ভাবধারা ও মানবিকতার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি যথার্থ সন্ন্যাসীর মতই জীবনযাপন করতেন। তিনি নারীদেরও বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে টেনে আনেন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত তাঁর দুই উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
বীনা দাস (১৯১১-৮৬ খ্রিঃ)
বাংলার মেয়েরাও সেদিন বিপ্লব কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যেই কুমিল্লার দুই স্কুল ছাত্রী শান্তি-সুনীতি কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স-কে হত্যা করেছেন (১৪ ডিসেম্বর, ১৯৩১)। ১৯৩২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি ছুঁড়লেন বেথুন কলেজের ছাত্রী এবং সুভাষচন্দ্রের শিক্ষাগুরু বেণীমাধব দাসের কনিষ্ঠা কন্যা একুশ বছরের বীণা দাস। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। কিন্তু এই ঘটনার তাৎপর্য ও প্রভাব ছিল বিরাট। সারা বিশ্ব সচকিত হয়ে দেখল বাংলার তরুণ-তরুণীর উন্মাদনা, আত্মদান এবং স্বাধীনতার আকুতি। গ্রেপ্তারের পর তিনি প্রকাশ্য আদালতে যে বিবৃতি দিলেন, তা অসাধারণ বীরত্বব্যাঞ্জক।
রশিদ আলি দিবস (১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৫ খ্রিঃ)
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাপান মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। দিল্লির ‘লালকেল্লা’-য় আজাদী সেনাদের বিচার শুরু হয়। এই বাহিনীর বীর সৈনিক ক্যাপ্টেন রশিদ আলি সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত হলে ১৯৪৬-এর ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতা গণ-আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সেদিন দুপুরে ছাত্ররা মিছিল করে ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক ঘন্টা ধরে পুলিশ লঠিচার্জ করে। এতে শতাধিক ছাত্র আহত হয়। আহতদের মধ্যে ছিলেন বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও কমিউনিস্ট নেতা সুনীল মুন্সী, গৌতম চট্টোপাধ্যায় এবং নৃপেন বন্দ্যোপাধ্যায়। পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি ছিল রশিদ আলি দিবস- কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অসামরিক প্রশাসন সেদিন ভেঙে পড়ে। দলে দলে মানুষ আন্দোলনে সামিল হয়। কিশোর কবি সুকান্ত সেদিন লেখন- “বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারদিকে, আমি যাই তারই দিন-পঞ্জিকা লিখে”। সেনা বাহিনীর ডাক পড়ে। পুলিশ ও মিলিটারির তান্ডবে জনজীবনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এর প্রতিবাদে সেদিন ওয়েলিংটন স্কোয়ারে এক কেন্দ্রীয় ছাত্রসমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট মুসলিম লিগ নেতা হোসেন শহীদ সোরাবদি, বিশিষ্ট গান্ধীবাদী নেতা সতীশ দাশগুপ্ত, ছাত্রনেতা শেখ মুজিবর (পরবর্তীকালের ‘বঙ্গবন্ধু’) এবং বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা গৌতম চট্টোপাধ্যায়।