সাম্যবাদী কবিতার বিষয়বস্তু ও বিশ্লেষণ

সাম্যবাদী কবিতার বিষয়বস্তু ও বিশ্লেষণ

সাম্যবাদী কবিতার বিষয়বস্তু ও বিশ্লেষণ
সাম্যবাদী কবিতার বিষয়বস্তু ও বিশ্লেষণ

গাহি সাম্যের গান বলে যাও, বল আরও

কবি কাজী নজরুল ইসলাম সামোর অর্থাৎ সমতার গান গাইতে চান। মানবসমাজে প্রতিটি মানুষের মধ্যে সমান অধিকারের আদর্শ প্রকাশ করতে চান। মানুষে মানুষে যেন কোনো ভেদাভেদ না থাকে। হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান ইত্যাদি সব ধর্মের মানুষেরাই যেন মিলেমিশে বাস করেন। এমনই এক চেতনার কথা কবি এই কবিতার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন মানুষের কাছে। পার্সি-জৈন-ইহুদি-সাঁওতাল-ভীল-গারো এইসব জাতি-গোষ্ঠী-ধর্ম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে মনুষ্যত্ব। কেউ কনফুসিয়াস, কেউ চার্বাকের দর্শন অনুসরণ করে চলতে পারেন। কিন্তু সব মানুষই সমান এই সাম্যবোধ সকলের থাকা প্রয়োজন। সম্প্রদায়ের পরিচয় মানুষের বাহ্যিক পরিচয়, অন্তর চেতনাই হল তার মানবতার চিহ্ন।

বন্ধু, যা খুশি হও,… পথে ফোটে তাজা ফুল

মানবজাতির সবাইকে ‘বন্ধু’ সম্বোধন করে কবি বলেছেন- অন্তরের পরিচয়ে সবাই মানুষ। জগতে অনেক ধর্ম প্রচলিত- তাদের প্রত্যেকের ধর্মগ্রন্থও আলাদা। তার দ্বারা মানুষের আসল পরিচয় চিহ্নিত হতে পারে না। ধর্মগ্রন্থ পড়া ব্যর্থ হয় যখন এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে হিংসায় লিপ্ত হয়। দোকানে জিনিস কিনতে গিয়ে দরাদরি করার মতো ধর্ম নিয়ে লড়াই ও বড়াই করলে ধর্মের মাহাত্ম্য নষ্ট হয়। পথের ধারে ফুটে থাকা তাজা ফুলকে উপেক্ষা করে গভীর অরণ্যে ফুল খুঁজতে যাওয়া মূর্খামি।

তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব… অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে

আমাদের মনের মধ্যে সকল শাস্ত্রের, সকল কালের জ্ঞানের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব। এজন্য হৃদয়কে প্রশস্ত করতে হয়। তাহলে মানুষ সব ধর্মের সার কথা নিজের হৃদয়ের মধ্যেই খুঁজে পাবে। মানুষের অন্তরেই সব ধর্মের যুগাবতার বাস করেন। হৃদয় হল সেই বিশ্ব দেউল যেখানে সমস্ত ধর্মের সব দেবতার বাস। তাই মৃত পুথির কঙ্কালে ঠাকুরদেবতাকে খুঁজে বেড়ানো বৃথা। দেবতার বাস মানুষের হৃদয়ের অন্তরালে।

বন্ধু, বলিনি ঝুট,…. পেল সত্যের পরিচয়

পাঠকবন্ধুদেরকে কবি বলেছেন, তিনি যা বলেছেন তা মিথ্যা নয়। কারণ মানুষের হৃদয়ে যদি ভালোবাসা থাকে তাহলে সেই ভালোবাসায় সব অহংকার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মানুষের হৃদয় হল তীর্থক্ষেত্রের মতো। আলাদা করে কোনো তীর্থস্থানে গিয়ে ঈশ্বরের সন্ধান বা পুণ্য অর্জন করার প্রয়োজন পড়ে না। মানুষের হৃদয়েই নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, জেরুজালেম, মদিনা, কাবা সব আছে। হৃদয়ের ডাকে সাড়া দিয়েই ঈসা, মুসা সত্যের পরিচয় পেয়েছেন।

এই রণ-ভূমে… মহা-বেদনার ডাক শুনি

সমাজ-সংসারের যুদ্ধক্ষেত্রেই বাঁশির কিশোর অর্থাৎ বংশীবাদক শ্রীকৃয় একসময় হৃদয়ের প্রেরণাতেই গীতার বাণী আবৃত্তি করেছিলেন। হৃদয়েই মেষের রাখাল-নবিদের সঙ্গে ঈশ্বরের সাক্ষাৎ হয়েছে। এই হৃদয় ধ্যানগুহার মতো। এখানে বসে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ মানুষের জাগতিক শোকতাপে কাতর হয়ে রাজকীয় ঐশ্বর্য ত্যাগ করেছেন। চিরমুক্তির মার্গসন্ধানশেষে তিনি হয়েছেন শাক্যমুনি বা বুদ্ধদেব।

এই কন্দরে আরব-দুলাল… মন্দির-কাবা নাই

হৃদয়ের গুহাতে আরব-দুলাল হজরত মহম্মদ খোদার ডাক শুনে কোরানের সাম্যের বাণী প্রচার করেছেন। কবি অন্তরের গভীর উপলব্ধি থেকে বুঝেছেন মানুষের হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির বা কাবা নেই। তিনি অন্তরের যে ডাক শুনেছেন তা মিথ্যা নয়। মানবতাই হল শ্রেষ্ঠ ধর্ম। সব ধর্মের মূলকথা। মানবমন্দিরেই সকল দেবতার অধিষ্ঠান। তাই বাইরে দেবতাকে না খুঁজে মানবতাবোধকে জাগ্রত করা প্রয়োজন।

Leave a Comment