সুখবাদ কী? চার্বাক সুখবাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও

সুখবাদ কী? চার্বাক সুখবাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও
সুখবাদ কী? চার্বাক সুখবাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও

সুখবাদ

যে দার্শনিক মতবাদ অনুযায়ী দাবি করা হয় যে, সুখই হল মানবজীবনের একমাত্র কাম্য-সেই মতবাদকেই বলা হয় সুখবাদ (Hedonism)। এরূপ মতবাদে দুঃখকে পরিহার করে, একমাত্র সুখকেই কামনা করা হয়েছে। সুখবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Hedonism। Hedonism শব্দটি গ্রিক Hedone শব্দ থেকে উদ্ভূত-যার অর্থ হল Pleasure তথা সুখ বা আনন্দ। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে দাবি করা হয় যে, সুখবাদ হল এমনই এক মতবাদ যে মতবাদ অনুসারে সুখ বা আনন্দকেই মানবজীবনের নৈতিক আদর্শরূপে গণ্য করা হয়। ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একমাত্র চার্বাক সম্প্রদায়ই সুখবাদের বিষয়টিকে সমর্থন করেছে।

চার্বাক সুখবাদদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

দেহাতিরিক্ত আত্মা না থাকায় দৈহিক সুখই কাম্য: চার্বাক মতে, চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হল আত্মা। চার্বাকরা দেহের অতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না। তাঁরা হলেন জড়বাদের প্রচারক। সে কারণেই দাবি করা যায় যে, চার্বাকদের নীতিতত্ত্ব (Ethics) সুখবাদ তথা ভোগবাদে পরিণত হয়েছে। দেহের অতিরিক্ত আত্মা বলে যদি কিছু না থাকে, তাহলে আত্মিক বা আধ্যাত্মিক সুখ বলেও কিছু থাকতে পারে না। সে কারণেই দেহসর্বস্ব চার্বাকগণ ইন্দ্রিয় সুখ- সম্ভোগকেই পরম পুরুষার্থ রূপে গণ্য করেছেন। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের মধ্যে চার্বাকগণ তাই কামকেই মুখ্য পুরুষার্থের মর্যাদা দিয়েছেন।

মুণ্ডহীন ব্যক্তির মাথাব্যথার মতো মোক্ষের ধারণা অলীক: চার্বাক সম্প্রদায় ছাড়া ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য সম্প্রদায়গুলি মোক্ষকেই পরম পুরুষার্থ বলেছেন। কিন্তু চার্বাকগণ মোক্ষকে স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, পরলোক বলে কোনোকিছুই নেই। দেহের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্যরূপ আত্মারও অবসান ঘটে। সুতরাং যতদিন বাঁচা যায়, ততদিন সুখভোগ করে বাঁচাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাঁরা তাই মোক্ষকে ‘মাথাবিহীন ব্যক্তির মাথাব্যাথার মতো বিষয়’ বলে উপহাস করেছেন।

ক্ষণিক ইন্দ্রিয়সুখ ভোগই বুদ্ধিমানের কাজ: চার্বাকগণ আরও দাবি করেন যে, আমাদের জীবন হল সুখ এবং দুঃখের এক সংমিশ্রণ। অবিমিশ্র সুখ বা দুঃখ বলে কোনো কিছুই নেই। জীবনে দুঃখ যেমন আছে, তেমনি সুখও আছে। মানুষের কর্তব্য হল দুঃখকে পরিহার করে শুধুমাত্র সুখ ভোগ করা। তাই চার্বাক নীতিতত্ত্বের সার কথা হল, ‘যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’, অর্থাৎ, যতদিন বাঁচো সুখে বাঁচো। পানভোজন ও আনন্দ করো, জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করো। দুঃখকে ত্যাগ করে সুখভোগ করো। ভবিষ্যতের অধিক সুখের আশায় বর্তমানের সুখকে কখনোই উপেক্ষা করা উচিত নয়। কৃত্রিম ফুল অপেক্ষা বাগানের ফুল ক্ষণস্থায়ী হলেও, তা আমাদের কাছে অধিক রমণীয়। অর্থাৎ, কল্পিত পরলোক ভাবনার চেয়ে ইহ লোকের সুখভোগ অনেক বেশি কাম্য। সুতরাং ইন্দ্রিয় বা দৈহিক সুখ ক্ষণস্থায়ী হলেও, তাকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করা উচিত। এভাবেই চার্বাকগণ তাঁদের সুখবাদকে ভোগবাদে পরিণত করেছেন।

Leave a Comment