![]() |
স্পেনের গৃহযুদ্ধ টীকা
|
পটভূমি
উনিশ শতকের শেষে স্পেন ছিল একটি দুর্বল ও দরিদ্র রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তার সমাজ ছিল মধ্যযুগীয় এবং নানা দ্বন্দ্বে ভরা। ভূসম্পত্তির অধিকাংশই ছিল জমিদার ও জোতদারদের হাতে। রাজপুরুষ, যাজক ও অভিজাতরা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপদার্থ। স্পেনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। বুরবোঁ বংশীয় ত্রয়োদশ অ্যালফান্সো স্পেনের সিংহাসনে ছিলেন। তাঁকে শাসনকাজে সাহায্য করত একটি সংসদ, যার নাম ‘করটেস্’।
নতুন সামরিক শাসন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্পেনে ভয়াবহ রাজনৈতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই চরম অরাজকতা দেখা দেয়। পাঁচ বছরে দশবার মন্ত্রিসভার পরিবর্তন ঘটে। শিল্প ধর্মঘট, শ্রমিক-মালিক বিরোধ ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রাজতন্ত্র দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ক্যাটালোনিয়ার সামরিক প্রশাসক প্রাইমো-ডি-রিভেরা শাসন ক্ষমতা দখল করেন এবং রাজা ত্রয়োদশ অ্যালফান্সো ‘রাজা’ উপাধি নিয়ে নামেমাত্র টিকে থাকেন। এরপর প্রাইমো-ডি-রিভেরা পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। অচিরেই তাঁর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দেশে বিদ্রোহ শুরু হলে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন।
প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে স্পেনে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় (১৯৩১ খ্রিঃ)। এই সরকার দেশে নানা প্রগতিবাদী সংস্কারের সূচনা করে। এতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হলেও জমিদার, সামন্তশ্রেণি ও দক্ষিণপন্থীরা প্রবল ক্ষুব্ধ হয়। এইসব শ্রেণির বিরোধিতা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকার-বিরোধী মনোভাব এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে দেশে এক চরম অরাজকতার সৃষ্টি হয়।
পপুলার ফ্রন্ট গঠন
১৯৩৬-এর নির্বাচনে প্রজাতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টরা মিলে এক ‘পপুলার ফ্রন্ট’ গঠন করে এবং নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়ে তারা সরকার গঠন করে। দক্ষিণপন্থীরা প্রথম থেকেই এই সরকারের বিরোধিতা করতে থাকে এবং দেশের নানা স্থানে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করে। এই অবস্থায় সরকার আনুগত্যহীনতার অভিযোগে বেশ কিছু সামরিক কর্মচারীকে বরখাস্ত, বদলি বা বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণে বাধ্য করে। জেনারেল ফ্রাঙ্কো-কে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এইসব কারণে সামরিক বিভাগে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং সেনাবাহিনীর অনেকেই সরকারের পতন ঘটাতে উদ্যোগী হয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মরোক্কোয় অবস্থিত স্পেনীয় সেনাদল প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসিত জেনারেল ফ্রঙ্কো মরোক্কোয় এসে বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
গৃহযুদ্ধ
সমগ্র স্পেনে ব্যাপক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী ও প্রজাতন্ত্রীরা প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করে। অপরপক্ষে ফ্যালাঞ্জিস্ট, ন্যাশনালিস্ট প্রভৃতি দক্ষিণপন্থী দল, যাজক, ভূস্বামী ও শিল্পপতিরা জেনারেল ফ্রাঙ্কোর প্রতি সমর্থন জানায়। এইভাবে সমগ্র স্পেন ‘জাতীয়তাবাদী’ ও ‘প্রজাতন্ত্রী’ এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা ‘জাতীয়তাবাদী’ এবং সরকার পক্ষ ‘প্রজাতন্ত্রী’ নামে পরিচিত হয়। স্পেনের পশ্চিমাঞ্চল ছিল ফ্রাঙ্কোর সমর্থক। অপরপক্ষে মধ্য স্পেন ছিল প্রজাতন্ত্রীদের পক্ষে।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও ভারতে প্রগতিশীল চিন্তা
স্পেনের গৃহযুদ্ধ বহু ভারতীয়কে নাড়া দিয়েছিল। ভারতীয়রা অনেকেই এই গৃহযুদ্ধকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে মনে করত। ‘নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন’-এর ডাকে ‘স্পেন দিবস’ পালিত হয়। ‘লাহোর ছাত্র ইউনিয়ন’, ‘স্পেন সংহতি সপ্তাহ’ পালন করে (মে, ১৯৩৬ খ্রিঃ)। জাতীয় কংগ্রেস ও গান্ধীজী প্রজাতন্ত্রীদের পক্ষে সমর্থন জানান ১৯৩৭ সালের ৩ মার্চ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘স্টেটম্যান ‘পত্রিকায় স্পেনে গণতন্ত্র, সত্যতা ও মানবতা রক্ষার আহবান জানান। ইংল্যান্ডে বসবাসকারী বহু ভারতীয় স্পেনের প্রজাতন্ত্রীদের পক্ষে আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। জওহরলাল নেহেরু, কৃষ্ণ মেনন, মুলকরাজ আনন্দ লন্ডনে এই আন্দোলন সংগঠিত করেন। ব্রিটেনে কৃয় মেনন আয়োজিত এক সভায় ইন্দিরা নেহেরু (গান্ধী) বক্তব্য রাখেন। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে লন্ডনে ‘ইন্ডিয়া লিগ’ অনুষ্ঠিত এক সভায় গান্ধীজি ও জওহরলালের ছবি-সহ প্রজাতন্ত্রী স্পেনের পক্ষে বিক্ষোভ দেখান হয়। ১৯৩৮ সালের গ্রীষ্মে জওহরলাল ও মেনন স্পেনে যান এবং সেখানে ট্রাফালগার স্কোয়ারে পাঁচ হাজার মানুষের সভায় ভাষণ দেন। ‘ইন্ডিয়া লিগ’ স্পেনে খাদ্য পাঠাবার জন্য একটি ‘ভারতীয় কমিটি’ গঠন করে। এর সম্পাদক ছিলেন ফিরোজ গান্ধী।
বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভূমিকা ও মতাদর্শগত বিরোধিতা
ঐতিহাসিক ল্যাংসাম এই গৃহযুদ্ধকে ‘ক্ষুদে বিশ্বযুদ্ধ ‘বলে অভিহিত করেছেন। এই যুদ্ধে প্রায় ১০ লক্ষ স্পেনবাসী নিহত এবং দেশত্যাগে বাধ্য হয়। ইউরোপের বহু দেশ কম-বেশি নানাভাবে এই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। স্পেনে বলশেভিক বিপ্লবের মতো কিছু ঘটতে পারে এই আশঙ্কায় হিটলার ও মুসোলিনি ফ্রাঙ্কোর সমর্থনে এগিয়ে আসেন। তাঁরা মনে করেন যে, ফ্রাঙ্কোর জয় হল একনায়কতন্ত্রের জয় এবং এর ফলে ইউরোপে ফ্যাসিবাদী শক্তি সুদৃঢ় হবে। ৫০ হাজার ইতালীয় স্বেচ্ছাসেবক বিদ্রোহীদের সাহায্যে স্পেনে যায়। নিজ প্রভাববৃদ্ধির আশায় রাশিয়া ‘পপুলার ফ্রন্ট’ সরকারের কাছে যুদ্ধাস্ত্র, সামরিক পরামর্শদাতা ও দক্ষ কারিগর পাঠায়। জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসি-বিরোধী উদ্বাস্তু এবং পৃথিবীর অন্যান্য বহু দেশের প্রজাতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টরা একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠন করে ‘পপুলার ফ্রন্ট’ সরকারকে সাহায্যের উদ্যোগ নেয়। এইভাবে এই যুদ্ধ একনায়কতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ বনাম সাম্যবাদের যুদ্ধে পরিণত হয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানি ও ইতালিকে তোষণ করা। গৃহযুদ্ধকে স্পেনের অভ্যন্তরে সীমাবন্ধ করে রাখার উদ্দেশ্যে ইউরোপের ২৭টি দেশ স্পেনের ব্যাপারে ‘হস্তক্ষেপ না করার নীতি’ গ্রহণ করে। তিন বছর যুদ্ধ চলার পর জেনারেল ফ্রাঙ্কো এই গৃহযুদ্ধে জয়ী হন এবং ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা এপ্রিল স্পেনে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
গুরুত্ব
এই গৃহযুদ্ধের প্রভাব কেবল স্পেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না- এর আন্তর্জাতিক প্রভাবও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। স্পেনে ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হিটলার-মুসোলিনি জোটের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। এই যুদ্ধের ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশগুলির কূটনৈতিক পরাজয় ঘটে এবং অপরদিকে জার্মানিই প্রবলভাবে লাভবান হয়। অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, মুসোলিনি নন- এই যুদ্ধের দ্বারা প্রকৃত লাভ হয় হিটলারের। এই যুদ্ধে হিটলার তাঁর বিমানবাহিনীর কার্যকারিতা ও অন্যান্য অস্ত্রের শক্তি পরীক্ষার সুযোগ পান। তাই এই গৃহযুদ্ধকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া ‘বলা হয়। এই যুদ্ধ সর্বসমক্ষে জাতিসঙ্ঘের অসারতা ও দুর্বলতা তুলে ধরে, কারণ তারা কোন কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।