রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ, স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগ ও মহাত্মা গান্ধীর অহিংসতা প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার দর্শন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ, স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগ ও মহাত্মা গান্ধীর অহিংসতা প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার দর্শন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ, স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ, স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগ

১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মানবতাবাদী দার্শনিক বলা হয় কেন?

আধুনিক ভারতীয় দর্শনের চিন্তাধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি যেসব কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটো গল্প, নাটক ইত্যাদি রচনা করেছিলেন তার দার্শনিক মূল্য ছিল অপরিসীম। বিশ্বসাহিত্যে নোবেলজয়ী এই মহান কবির সকল সৃষ্টিই আমাদের জীবনে চলার পথে অন্যতম পাথেয়। বলাই বাহুল্য তিনি তাঁর সৃষ্টিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের মধ্যে এক মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর সমগ্র রচনায় যে দার্শনিক চিন্তাধারা প্রকাশিত হয়েছে তাতে বিশ্বমানবতার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। মানবতার পূজারি হিসেবে পরিচিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এই কারণে মানবতাবাদী দার্শনিকরূপে আখ্যায়িত করা হয়।

২। মানবতাবাদ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ লেখো। 

‘মানবতাবাদ’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Humanism। ‘Humanism’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Humanitas থেকে। ‘Humanitas’ শব্দটির অর্থ হল জীবনের সর্বাঙ্গীণ বা পরিপূর্ণ বিকাশসাধন। সুতরাং ‘মানবতাবাদ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল একজন মানুষের প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য প্রয়োজন তার অন্তঃস্থ শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে পূর্ণতা সাধন করা। অর্থাৎ মানবতাবাদ বলতে বোঝায় এমন এক মতবাদকে যা সকল মানুষকে একসূত্রে বেঁধে রাখে এবং দেশপ্রেম থেকে বিশ্বপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। এই মানবতাবাদ সামগ্রিকভাবে সমাজের কল্যাণের কথা চিন্তা করতে শেখায়। এটি কোনো মানুষের নিজের বা কোনো গোষ্ঠী বা জাতির কল্যাণের কথা নিয়ে চিন্তা করে না।

৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে মানবতাবাদের সংজ্ঞা দাও।

রবীন্দ্রনাথের মতে মানবসমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনের প্রতি ব্যক্তি মানুষের যে দায়বদ্ধতা তাই হল মানবতাবাদ। অর্থাৎ যে মতবাদে মানুষের সামগ্রিক মঙ্গল সাধনের কথা বলা হয় এবং মানবসমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও কল্যাণের কথা প্রচার করা হয় তাকে বলা হয় মানবতাবাদ। সমাজ জীবনের যাবতীয় বিচার-বিবেচনার মূলে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী দর্শন।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে অক্সফোর্ডের ম্যানচেস্টার কলেজে আয়োজিত একটি সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিন দিন ব্যাপী বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতার সংকলিত রূপ The Religion of Man নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। মানবতাবাদের মূলকথা হল মানবতার জয়গান, যা সকল মানুষকে একই সূত্রে গ্রথিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই সর্বপ্রথম মানবতাবাদকে মানুষের ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘The Religion of Man’ এবং মানুষের ধর্ম গ্রন্থ দুটি কি এক?

উত্তর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে অক্সফোর্ডের ম্যানচেস্টার কলেজে আয়োজিত একটি সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরপর তিন দিন ব্যাপী ‘হিবার্ট বক্তৃতা’ দেন। এই বক্তৃতার সংকলিত রূপ The Religion of Man নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ মানবতাবাদের ধারণার উপর জোর দিয়েছেন।

এর পরবর্তীকালে তিনি ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর তিন দিন ধরে ‘কমলা বক্তৃতা’ দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতার সংকলিত রূপ মানুষের ধর্ম নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে তিনি মানুষকে কখনো-কখনো ঈশ্বরের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। আবার কখনো-কখনো তিনি ঈশ্বরকে নামিয়ে এনেছেন মানুষের স্তরে। The Religion of Man ও মানুষের ধর্ম নামক দুটি গ্রন্থে নামের মধ্যে যেমন সাদৃশ্য আছে তেমনই বিষয়বস্তুতেও কিছুটা সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। তবে দ্বিতীয় গ্রন্থটি প্রথম গ্রন্থটির অনুবাদ নয়।

৫। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী ভাবনার কয়েকটি উৎস উল্লেখ করো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য, দর্শন ও জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদের মূল উৎসগুলি নিম্নরূপ-

উপনিষদীয় ভিত্তি: রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী দর্শনে বেদান্ত বা উপনিষদের গভীর প্রভাব রয়েছে। উপনিষদে ‘একম্ ব্রহ্ম’ অর্থাৎ ঈশ্বরের একত্বের কথা বলা হয়েছে। এই ধারণাকেই রবীন্দ্রনাথ মানবতাবাদের আলোকে গ্রহণ করেছেন।

ধর্মীয় ভিত্তি: রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় ভাবধারা প্রচলিত ধর্মীয় রীতি-নীতি বা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ধর্মকে মানবতাবাদের আলোকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং এর মাধ্যমেই মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির পথের কথা ভেবেছেন।

প্রাকৃতিক, লোক সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি : রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে মানুষের শিক্ষক এবং আশ্রয় মনে করতেন। তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য ও রহস্য থেকে মানবতাবাদের অনেক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি মানবতাবাদের অনেক উপাদান তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন বাউলের গান, লোককথা এবং গ্রামীণ জীবনযাত্রার থেকে।

সামাজিক ভিত্তি : রবীন্দ্রনাথ ব্রাত্মসমাজের প্রভাবে মানবতাবাদী চিন্তাধারা গ্রহণ করেছিলেন, যা তৎকালীন সমাজের বৈষম্য ও অনাচার দূর করার কাজে সহায়ক হয়েছিল।

পরিশেষে বলা যায় যে সকল উৎসের সংমিশ্রণে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ সর্বজনীন, উদার ও অসাম্প্রদায়িকতার ইঙ্গিত বহন করে চলেছে।

৬। রবীন্দ্রনাথের মতে মানবতাবাদ কয় প্রকার ও কী কী? তাদের সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে মানবতাবাদ দুই প্রকার। সেগুলি হল- নরকেন্দ্রিক মানবতাবাদ এবং ঈশ্বরকেন্দ্রিক মানবতাবাদ।

নরকেন্দ্রিক মানবতাবাদ: এই মানবতাবাদ অনুসারে মানুষ হল তার নিজের কেন্দ্রবিন্দু। তাই বলা যায় জগতের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুও মানুষ। এইরূপ মানবতাবাদ মানুষের অহং-এর উপর মাত্রাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। ফলে আত্মার সঙ্গে অনাত্মার এবং বিচারবুদ্ধির সঙ্গে বিশ্বাসের এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

ঈশ্বরকেন্দ্রিক মানবতাবাদ: এই মতবাদ অনুসারে প্রতিটি মানুষের প্রতি সেবা, প্রীতি ও প্রেমকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এখানে ধর্মের দ্বারা মানুষ এবং ঈশ্বরকে যুক্ত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক চিন্তায় এই মানবতাবাদের তত্ত্বটিই প্রকাশিত হয়েছে।

৭। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ধর্ম কী?

জয় ভারতীয় দর্শনে স্বীকৃত চারটি পুরুষার্থের মধ্যে ধর্ম হল অন্যতম। ‘ধর্ম’ শব্দটি এসেছে ‘ধ’ ধাতুর সঙ্গে ‘মন’ প্রত্যয় যোগ করে। ‘ধৃ’ ধাতুর অর্থ হল ধারণ করা। যা ধারণ করে তাই হল ধর্ম। অর্থাৎ ধর্ম হল সেই নিয়ম যা সমাজকে ধরে রাখে, শৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং মানুষের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর The Religion of Man গ্রন্থে মানুষের মধ্যে দুই রকম ধর্মের উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও মানবধর্ম।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম: যে-কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িক ধর্মকে বলা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মকে শুধুমাত্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা বিধি-নিষেধের সমষ্টি হিসেবে দেখেননি। তিনি ধর্মকে মানুষের অন্তরের সত্য, ভালোবাসা এবং সহানুভূতির সঙ্গে একত্রিত করে দেখেছেন।

মানবধর্ম: জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করাকে বলে মানবধর্ম। এই ধর্মের উদ্দেশ্য হল বিশ্বের সকল জীবের প্রতি কল্যাণ সাধন করা।

রবীন্দ্রনাথের The Religion of Man গ্রন্থ অনুসারে, ধর্মের প্রকৃত অর্থ হল মানুষের মধ্যেকার সেই গভীরতম সত্তার উপলব্ধি, যা তাকে বিশ্বজগতের সঙ্গে একাত্ম করে তোলে। এই অনুভূতি মানুষকে ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে মুক্ত করে বৃহত্তর মানবসত্তার সঙ্গে যুক্ত করে। তিনি মনে করতেন যে মানুষের মধ্যে যে অনন্ত সম্ভাবনা রয়েছে, ধর্ম সেই অনন্ত সম্ভাবনাকে বিকাশের পথ দেখায়। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের মতে মানবপ্রেমই হল ধর্মের মূল ভিত্তি।

৮। রবীন্দ্রনাথ কীভাবে মানবষর্ম ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মধ্যে পার্থক্য করেছেন?

রবীন্দ্রনাথের মতে মানবধর্মই হল প্রকৃত ধর্ম। এটি সকল মানুষের মধ্যে সমতা, ভ্রাতৃত্ব এবং সহযোগিতার বোধ জাগিয়ে তোলে। এর মধ্যে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। মানবধর্ম হল আত্মজ্ঞানের অন্বেষণ। এটি ব্যক্তির অন্তরের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপন করে। তাঁর মতে মানবধর্মের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা এবং স্বাভাবিকতা থাকে।

অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম প্রতিষ্ঠানের দাসে পরিণত হয়। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে নির্বিচার এবং মিথ্যা বলেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম প্রায়ই মানুষকে একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার মধ্যে আবন্ধ করে রাখে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মধ্যে অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে।

৯। শ্রেয় ও প্রেয় কাকে বলে?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের স্বভাবের দুটি দিকের কথা বলেছেন। যথা- শ্রেয় এবং প্রেয়।

শ্রেয়: ‘শ্রেয়’ শব্দের অর্থ প্রশস্যতর। যে নৈতিক আদর্শ মানুষকে আত্মিক উন্নতি-সহ প্রকৃত সুখের দিকে পরিচালিত করে তাকে শ্রেয় বলে। শ্রেয় হল তাই যা আমাদের চাওয়া উচিত। শ্রেয়র পথ অবলম্বনকারী মানুষকে ধৈর্যশীল, সংযমী, বিচারশীল ও বিবেকবান হতে হয়। শ্রেয় মানুষকে পূর্ণ ও শাশ্বত সুখের দিকে নিয়ে যায়।

প্রেয়: ‘প্রেয়’ শব্দের অর্থ প্রিয়তর বা সুখকর। মানুষ পার্থিব সুখভোগের জন্য যেসব কর্ম করে তাকে প্রেয় বলে। প্রেয় হল তাই যা আমরা পেতে চাই বা ইচ্ছা করি। এইসকল কর্মের দ্বারা মানুষের মুক্তি প্রাপ্তি হয় না। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই সুখভোগের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়।

১০। মানবধর্ম বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী বুঝিয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথের মতে প্রকৃত অর্থে ‘মানবধর্ম’ বলতে বোঝায় যে সকল ভেদবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে সকল কিছুর মধ্যে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে সমর্পণ করা। বিশ্বজনীন কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করাই হল মানুষের প্রকৃত ধর্ম বা মানবধর্ম। রবীন্দ্রনাথের মতে মানুষের মধ্যে পার্থিব জগতের তুলনায় একটি অতিরিক্ত সচেতন সত্তা আছে তা হল মনুষ্যত্ব। এই চিরন্তন সৃজনশীল শক্তিই হল মানুষের ধর্ম। এই ধর্ম সাধারণ মানুষের ধর্ম নয়। এই ধর্মকে পেতে হলে মানুষকে সাধনা করতে হয়। তাঁর মতে আমাদের অন্তরে যে মানব আছেন, তিনি ব্যক্তিমানবকে অতিক্রম করে থাকেন। এই মানব সর্বজনীন এবং সর্বকালীন মানব। এই সর্বকালীন মানবের ধর্মই মানবধর্ম।

১১। রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে সর্বজনীন, সর্বকালীন বিশ্বমানব বলেছেন কেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ঈশ্বরই হলেন মহামানব। এই মহামানব ঈশ্বর কোনো মন্দির, মসজিদ বা গীর্জায় সীমাবন্ধ নন। রবীন্দ্রনাথ যে ঈশ্বর সাধনার কথা বলেছেন তিনি সমস্ত ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতার গণ্ডি পেরিয়ে মহামানব। তিনি মনে করেন প্রকৃত ঈশ্বরকে খুঁজে নিতে হবে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তাঁর মতে মানুষের সেবা করার অর্থ হল ভগবানের সেবা করা। তিনি বলেন একমাত্র মানবকল্যাণের মধ্যে দিয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সেবাপরায়ণতার দিকটি প্রকাশিত হয়। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভারততীর্থ কবিতায় বলেছেন, যে মানুষকে তিনি ঈশ্বরের সমান আসন দিতে চেয়েছিলেন সেই মানুষ কোনো গোষ্ঠীভুক্ত বা সম্প্রদায়গত বা বিশেষ কোনো ধর্মভুক্ত মানুষ নয়। তাই তিনি এই মানুষের নাম দিয়েছেন বিশ্বমানব, মহামানব ও সনাতন মানব।

কারণ মন্দিরে ঈশ্বরের যে বিগ্রহ আমরা প্রতিষ্ঠা করে আরাধনা করি তা প্রাণহীন এক সত্তা। পরবর্তীকালে এই সেবা মানুষকে শাস্তি জোগাতে সাহায্য করে ও বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধকে জাগিয়ে তোলে। তাই রবীন্দ্রনাথের মানসলোকের কেন্দ্রবিন্দু হল মানুষ।

১২। মানুষের মধ্যে উদ্বৃত্ত বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বুঝিয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথের মতে ‘মানুষের মধ্যে উদ্বৃত্ত’ বলতে বোঝায় সেই অতিরিক্ত শক্তি বা ক্ষমতাকে, যা তাকে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য নয় বরং সৃষ্টিশীল, পরোপকারী এবং উচ্চতর আধ্যাত্মিক লক্ষ্যে পৌঁছোতে সাহায্য করে। এটিই মানুষকে প্রেম, করুণা, ত্যাগ এবং সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষিত করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্য থাকার ফলে মানুষ তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত হয়। আবার মানুষের পক্ষে কোনো কাজ সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব, এমনটাও নয়। মানুষের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু তার ব্যর্থতা তাকে নব নব প্রয়াস গ্রহণে উৎসাহী করে তোলে। এটি মানুষকে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যই সীমাবদ্ধ রাখে না বরং তাকে নতুন কিছু সৃষ্টি বা উদ্ভাবন করতে এবং জীবনকে আরও বেশি সমৃদ্ধশীল করতে অনুপ্রাণিত করে। মানুষের এই উপাদানকেই রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের মধ্যে উদ্বৃত্ত’ (The Surplus in Man) বলেছেন।

১৩। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবতাবাদে ছোটো আমি বা ক্ষুদ্র আমি এবং বড়ো আমি বা বৃহৎ আমি বলতে কী বুঝিয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর The Religion of Man গ্রন্থে প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের মধ্যে দুটি সত্তার কথা উল্লেখ করেছেন। যথা- ছোটো আমি বা ক্ষুদ্র আমি এবং বড়ো আমি বা বৃহৎ আমি।

ছোটো আমি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ছোটো আমি’ বা ‘ক্ষুদ্র আমি’-কে জীবসত্তা বলেছেন। জীবসত্তা হল সাধারণ ব্যক্তিমানবের স্বভাব, যার মধ্যে স্বার্থপরতা, দ্বেষ-বিদ্বেষ ইত্যাদি বিষয়গুলি নিহিত থাকে। তাঁর মতে জীবসত্তা ব্যক্তিকে নিছক জীব হিসেবেই গণ্য করে। মানুষের জীবসত্তা তাই নানা প্রকার জৈবিক কামনা-বাসনা এবং সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ।

বড়ো আমি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ‘বড়ো আমি’ বা ‘বৃহৎ আমি’ হল বিশ্বসত্তা। এই বিশ্বসত্তা হল মহৎ, যা সকল মানুষকে কাছে টানে। ব্যক্তিমানব যখন জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও বর্ণকে অতিক্রম করে বিশ্ব চেতনায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, তখনই সে বিশ্বসত্তাকে লাভ করতে পারে। এর ফলে সে অহং ব্রহ্মাস্মি অর্থাৎ আমি ব্রহ্ম- এই রূপ উপলব্ধিতে সক্ষম হয়। এটিই মানুষের সর্বোচ্চ আদর্শ।

১৪। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবতাবাদী ভাবনায় মানুষের মধ্যে কীরূপ দ্বৈততা (Duality)-র কথা উল্লেখ করেছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন যে প্রতিটি মানুষের মধ্যে ব্যক্তিসত্তার দুটি ভিন্ন দিক লক্ষ্য করা যায়। যথা- প্রকৃতিগত বা বস্তুগত দিক ও আত্মিক বা চেতনার দিক। প্রকৃতিগত কারণের ফলে মানুষ কখনো-কখনো স্বার্থপর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আত্মিক সত্তা থাকার ফলে মানুষ উদারতা, প্রেম ও মানবতার পথে পরিচালিত হয়। এই দুই বিপরীত প্রবণতা মানুষের মধ্যে এক ধরনের দ্বৈততা তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ মানুষের এই দ্বৈততাকে অস্বীকার করে না বরং তা স্বীকার করেই মানবিক মূল্যবোধের দীর্ঘায়ু কামনা করে। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ তার সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করে এক বৃহত্তর মানব সমাজের জন্য কাজ করতে পারে এবং প্রেম, সৌন্দর্য ও জ্ঞানের সাধনার মাধ্যমে এই দ্বৈততা কাটিয়ে উঠতে পারে।

১৫। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে উপনিষদে বর্ণিত সোহহম্ মহাবাক্যটির তাৎপর্য কী?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদের কেন্দ্রে রয়েছে বেদ ও উপনিষদের বাণী। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের উপনিষদীয় চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার অভিন্নতার কথা উল্লেখ করেন। উপনিষদীয়

‘সোহহম্’ মহাবাক্যটির অর্থ হল সেই-ই আমি এবং আমি-ই-সেই। এই ‘সেই’ বলতে তিনি বিশ্বমানবকে বুঝিয়েছেন। যিনি সর্বজনীন ও সর্বকালীন মানব। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে প্রতিটি মানুষের মধ্যে দ্বিবিধ সত্তা আছে- একটি হল জৈবিক সত্তা যা তার দেহ, মন, দেশ ও কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ। কিন্তু সেই সীমিত সত্তার অতিরিক্ত আরও একটি সত্তা আছে, রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘আমার আমি’ বা ‘আত্মা’ বলেছেন। উপনিষদীয় মহাবাক্য ‘সোহহম্’-এর সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি এই আত্মার সঙ্গেই পরমাত্মার অভিন্নতাকে বোঝাতে চেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে পরমাত্মার সঙ্গে মনুষ্যজীবরূপ আমার কোনো ভেদ নেই।

সুতরাং রবীন্দ্রনাথের মতে পরমাত্মা ঈশ্বর জগতের বাইরের কোনো অলৌকিক সত্তা নন। তিনি এই সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মনের অন্তঃস্থলে বিদ্যমান আত্মা।

১৬। রবীন্দ্রনাথের মতে মানুষ কখন পরম বাক্তিকে চায়?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শনে ‘পরম ব্যক্তি’ বা ‘সর্বোচ্চ ব্যক্তি’ বলতে সাধারণত একজন নিখুঁত, সম্পূর্ণ এবং সর্বোত্তম ব্যক্তিকেই বোঝানো হয়। তাঁর মতে মানুষের মধ্যে এক গোপন সত্তা আছে, যা মানুষকে সমস্ত শুভ কর্মের প্রেরণা জোগায়। এই সত্তা জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের আদর্শে ব্রতী। দুঃখকষ্টের দ্বারা মানুষের অস্তিত্ব যখন স্বাদহীন ও অর্থহীন হয়ে পড়ে তখন সে সান্ত্বনা, প্রেম এবং শক্তির চাহিদা অনুভব করতে চায়। আর ঠিক এই সময় সে পরম ব্যক্তির সান্নিধ্য চায়। রবীন্দ্রনাথের মতে পরম ব্যক্তিকে কেবল বাইরে খুঁজতে হয় না, তাকে নিজের মধ্যেই খুঁজতে হয়। মানুষের মধ্যে যেসকল সুন্দর গুণাবলি রয়েছে, সেইগুলিই পরম ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি।

১৭। মানবতাবাদ কেন সর্বজনীন মতবাদ হিসেবে গড়ে উঠেছে?

ঘরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর The Religion of Man নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে মানুষের প্রকৃতি হল সে বিশ্বমানবতার অঙ্গ। তিনি মানুষকে একজন স্বাধীন চিন্তাশীল এবং সৃজনশীল প্রাণী হিসেবে দেখতেন। তিনি মানুষের মধ্যে যে সর্বজনীন মানবতার ধারণা তুলে ধরেছেন, তা স্থান, কাল নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যে যে একত্বের ধারণা তুলে ধরেছেন, তা জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও বর্ণের অতীত। তাই রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ আমাদের মানবিক মূল্যবোধের প্রতি ফিরে যেতে অনুপ্রাণিত করে। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ সর্বজনীন মতবাদ হিসেবে গড়ে উঠেছে।

১৮। মানুষের দেবতা ও মানুষের মনের মানুষ এর তাৎপর্য লেখো।

উত্তর ‘মানুষের দেবতা’ ও ‘মানুষের মনের মানুষ’ এই কথাটি বিশ্বভাব বা মানবভাবের প্রতিফলন। এখানে ‘মানুষের দেবতা’ বলতে মানুষের মধ্যেকার সেইসব গুণাবলিকে বোঝানো হয়েছে যা তাকে মহত্ব বা মহামানবের দিকে নিয়ে যায়। আর ‘মানুষের মনের মানুষ’ বলতে সেই ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে যে অন্যের দুঃখকষ্টে সহানুভূতিশীল এবং পরার্থপরতায় উদ্বুদ্ধ। তাঁর মতে মানুষই হল সবচেয়ে বড়ো দেবতা। মানুষের মধ্যে যে প্রেম, দয়া, সহানুভূতি, সৃজনশীল এবং আত্মত্যাগের গুণাবলি রয়েছে, তা ঈশ্বরেরই প্রতিচ্ছবি। মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে ঈশ্বরের এই গুণাবলি প্রকাশ করে এবং নিজের জীবনকে সার্থক করে তোলে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে সকল মানুষই এক এবং তাদের মধ্যে এক অন্তর্নিহিত ঐক্য বিদ্যমান। এই ঐক্যের কারণেই মানুষ একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই ‘মানুষের দেবতা’ এবং ‘মানুষের মনের মানুষ’ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই তিনি মানুষের সেই সম্ভাবনাকে জাগ্রত করতে এবং মানবতাবাদের পথে মানুষকে চলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

১৯। কর্ম শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ লেখো।

‘কর্ম’ শব্দটি সংস্কৃত ‘কৃ’ধাতু থেকে নিঃসৃত হয়েছে। ‘কৃ’ ধাতুর অর্থ হল করা। অর্থাৎ আমরা যা কিছু করি তাই হল কর্ম। পরিভাষাগত দিক থেকে কর্ম বলতে কর্মফলকে বোঝায়। এই কর্মফল বলতে বোঝানো হয় পূর্বজন্মে যেসব কর্ম করা হয়েছিল তার ফল। তবে ‘কর্মযোগ’ শব্দটির ব্যবহার বা প্রয়োগ করার সময় ‘কর্ম’ কথাটিকে কর্মফল না বুঝিয়ে শুধুমাত্র কর্ম বা কাজ অর্থে বোঝানো হয়েছে। কর্মযোগে যে কর্মের কথা বলা হয় তা হল অনাসক্ত কর্ম। অর্থাৎ যে কর্মে ফলের প্রতি কোনো আসক্তি থাকে না। এই জন্যই কর্মের সঙ্গে ‘যোগ’ শব্দটির উল্লেখ করা হয়।

২০। যোগ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ লেখো।

‘যোগ’ শব্দটি সংস্কৃত ‘যুজ’ ধাতুর সঙ্গে ‘ঘঞ’ প্রত্যয় সংযোগে নিঃসৃত হয়েছে। ‘যুক্ত’ ধাতুর অর্থ হল যুক্ত করা। অর্থাৎ একটির সঙ্গে আর একটি বিষয়ের সংযোগকে সাধারণত ‘যোগ’ শব্দের মাধ্যমে বোঝানো হয়। কিন্তু ভারতীয় দর্শনে ‘যোগ’ শব্দটির দ্বারা একাগ্র চিত্তে বিষয়ের প্রতি নিবিষ্টতাকে বোঝানো হয়েছে। এই অর্থে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগ অর্থাৎ নিজ বুদ্ধিকে ঈশ্বরের বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করাই হল যোগ। গীতাকে অনুসরণ করে বলা যায় সুখ-দুঃখ, লাভক্ষতি প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে সমমনোভাবাপন্ন, উদাসীন, নিরাসক্ত হয়ে নিষ্কামভাবে কর্ম করাই হল যোগ।

২১। স্বামী বিবেকানন্দ যোগ-বলতে কী বুঝিয়েছেন?

স্বামী বিবেকানন্দ ‘যোগ’ বলতে মানুষের শারীরিক মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য এক ধরনের অনুশীলনকে বোঝান। যোগ হল এমন একটি অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া যা আত্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমে মানুষের চেতনা ও আত্মবিশ্বাসকে উন্নত করে। তিনি মনে করতেন যোগ-ই একমাত্র পথ যার মাধ্যমে আত্মা অমরত্বকে উপলব্ধি করতে পারে। যোগ-এর মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের মনের অশান্তি দূর করে তাকে শান্ত স্থির এবং একাগ্র করা। ‘যোগ’ বলতে বোঝায় এক ঐক্য এবং একাগ্রতার শৃঙ্খলা। কাজেই বিবেকানন্দের মতে যোগ হল এমন এক পথ যার অনুশীলনের ফলে ঐক্যের অনুভূতি পাওয়া যায় এবং অমরত্বের উপলব্ধি হয়। জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ, রাজযোগ-বিবেকানন্দ এই চার প্রকার যোগ-এর কথা বলেছেন।

২২। বিবেকানন্দের মতে জ্ঞানযোগ বা জ্ঞানমার্গ কী?

জ্ঞানযোগ বা জ্ঞানমার্গ হল জ্ঞানের মাধ্যমে আত্মা ও পরমাত্মার একত্ব উপলব্ধি। বিবেকানন্দের মতে অবিদ্যা প্রসূত বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে জ্ঞানযোগ বা জ্ঞানমার্গের প্রয়োজন। আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান কেবল শাস্ত্র অধ্যয়ন দ্বারা সম্ভব নয়, এর সঙ্গে প্রয়োজন ধ্যান বা একাগ্রতার অনুশীলন। এই অনুশীলনকে বলা হয় আত্মোৎসর্গ। ধ্যানের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ধ্যানের বিষয় নির্বাচন করে দেহের পূর্ণ শক্তিকে জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্য নিয়োজিত করতে হয়। এই প্রকার ধ্যান গভীরতর হলে মুক্তিকামী ব্যক্তি সমাধির স্তরে পৌঁছায়। এই সময় আত্মা ও ব্রহ্যের ভেদ বিলুপ্ত হয় এবং পূর্ণ ঐক্যের জ্ঞান হয়। একেই জ্ঞানযোগ বা জ্ঞানমার্গ বলে।

২৩। বিবেকানন্দের মতে ভক্তিযোগ বা ভক্তিমার্গ কী?

ভক্তিযোগ হল সাধনার পথ, যার দ্বারা ঈশ্বরের প্রতি অগাধ ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমে মুক্তি লাভ করা হয়। বিবেকানন্দের মতে এই গভীর ভাবাবেগের দ্বারা মানুষের অব্যক্ত শক্তিকে জাগ্রত ও সক্রিয় করে তোলা সম্ভব, যার দ্বারা মানুষ নিজেই ঈশ্বরকে জানতে পারে। যে যোগ সাধনা বা মার্গ দ্বারা সাধারণ ভাবাবেগ গভীর ভাবাবেগে রূপান্তরিত হয় এবং সাধারণ প্রেম পরম ভক্তি স্বরূপ ঐশ্বরিক প্রেমে পরিণত হয় তাকেই বলা হয় ভক্তিযোগ বা ভক্তিমার্গ। এই পথ সকলের জন্য উন্মুক্ত এবং এটি মানুষকে জীবনের সর্বোচ্চ সুখ প্রদান করে। এককথায় বলা যায় ভক্তি ও প্রেমের দ্বারা দেবত্বের উপলব্ধি হল ভক্তিযোগ।

২৪। বিবেকানন্দের মতে রাজযোগ কী?

রাজযোগ দ্বারা দেহ এবং মনকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্রহ্মের সান্নিধ্য লাভ করা হয়। রাজযোগ স্তরে মন এবং দেহকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অমরত্ব উপলব্ধি করা যায়। এই স্তরে কিছু দৈহিক ও মানসিক শৃঙ্খলার মাধ্যমে দেহ ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই প্রকার যোগকে যোগের রাজা বলা হয়। রাজযোগ অনুসারে আমাদের বাহ্যজগত হল অন্তর্জগতের একটি স্থূল রূপ মাত্র। তাই বাহ্যজগতকে কার্য বলা যায়, আর অন্তর্জগতকে বলা যায় কারণ। রাজযোগ অনুশীলনের জন্য যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই অষ্টাঙ্গ যোগের প্রয়োজন, যা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভে সহায়ক।

২৫। বিবেকানন্দ কেন কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগকে অবিরোধী যোগদ্বয় বলে উল্লেখ করেছেন?

ভারতীয় দর্শনচিন্তায় মোক্ষ বা মুক্তি লাভের পথ বা উপায় হিসেবে মূলত জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ ও ভক্তিযোগের উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগের মধ্যে কোনো বিরোধিতা নেই। এরা একে অপরের পরিপূরক। মানব জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ উভয় পথই প্রয়োজন।

যে-কোনো ব্যক্তির মোক্ষ লাভের জন্য যেমন স্বার্থশূন্য হয়ে পরার্থে কাজ করা দরকার (কর্মযোগ) তেমনই সত্যের উপলব্ধি (জ্ঞানযোগ) হওয়াও একান্ত প্রয়োজন। কর্মের মধ্যে দিয়ে আত্মশুদ্ধি হয় আর জ্ঞান বা চিন্তার মাধ্যমে আমাদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়, যা আমাদের মোক্ষপ্রাপ্তির, পথকে প্রশস্ত করে।

জ্ঞানযোগ দ্বারা মানুষ সকল বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে এক অনুভব করে। আর কর্মযোগ শেখায় সেই একত্ব জ্ঞানের ভিত্তিতে কামনাশূন্যভাবে কর্ম করতে। আর সেই কারণেই বিবেকানন্দ জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগকে ‘অবিরোধী যোগদ্বয়’ বা একে অপরের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করার যোগ বলে বর্ণনা করেছেন।

২৬। কর্মযোগের উদ্দেশ্য কী?

জগতের কোনো প্রাণীই একমুহূর্ত কাজ না করে থাকতে পারে না। আমরা সর্বদাই শারীরিকভাবে এবং মনে মনে সচেতন বা অচেতনভাবে কাজ করে চলেছি। এই নিরন্তর কর্মের স্রোতকে নিয়ন্ত্রিত করে ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত করাই হল কর্মযোগ। কর্মযোগের উদ্দেশ্য হল পরম সত্তার (ঈশ্বর) কাছে মানুষের সকল কর্মের উৎসর্গ। স্বামীজি বলেছেন আমাদের স্বার্থসাধনে বা জাগতিক ফলপ্রাপ্তির জন্য কর্মের প্রচেষ্টা ত্যাগ করাই হল কর্মযোগের প্রথম কাজ।

জন্মজন্মান্তর ধরে মানুষ ভালো-মন্দ নানা কাজ করে চলেছে। আর এই কাজগুলি মানুষকে এক জন্ম থেকে আর এক জন্মের দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। মানুষ যদি কর্মযোগের দ্বারা নিরন্তর এই কর্মস্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, স্বার্থহীনভাবে কোনো ফলাকাঙ্ক্ষা ছাড়াই কর্ম করতে পারে, তখনই স্বার্থহীন কাজ ক্রমে ক্রমে নিষ্কাম কর্মে পরিণত হবে।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক চতুর্থ সেমিস্টার দর্শ্ন প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment