অন্ধকার লেখাগুচ্ছ কবিতার বিষয়বস্তু ক্লাস 12 তৃতীয় সেমিস্টার বাংলা | Ondhokar Lekhaguccha Kobitar Bishoybostu

উৎস
পাঠ্য ‘অনধকার লেখাগুচ্ছ’ কবিতাটি কবি শ্রীজাত-র ‘অনধকার লেখাগুচ্ছ’ কাব্যগ্রন্থের ১৪ সংখ্যক কবিতা। ২০১৫ সালে কবি ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ শিরোনামে প্রায় তেতাল্লিশটি কবিতা একটি সিরিজ হিসেবে ফেসবুকে প্রকাশ করা শুরু করেন, সেই সময়েই তিনি এই কবিতাটি লেখেন। পরবর্তীকালে এই সিরিজটি সিগনেট প্রেস থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
পরে লেখকের ‘কবিতা সমগ্র’-এর তৃতীয় খণ্ডে (আনন্দ পাবলিশার্স) কবিতাটি স্থান পায়।
প্রেক্ষাপট
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে তখনও প্রাণ নিয়ে লড়াই করছেন এক ব্যক্তি। পাশে রাফিদা আহমেদ বন্যা, তাঁর স্ত্রী। তিনিও তখন লড়াই চালাচ্ছেন, জীবনের সতোই। কিন্তু সব যুদ্ধে তো জেতা যায় না। বইমেলা থেকে ফেরার পথে দুষ্কৃতিদের দ্বারা আক্রান্ত অভিজিৎ রায়কেও তাই চলে যেতে হয় জীবনের অন্তিম বসন্তের খোঁজে। কিন্তু কে এই অভিজিৎ রায়? কেনই বা চলে যেতে হল তাঁকে?
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার অভিজিৎ রায় ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রবাসী লেখক। তিনি, তাঁর সমমনস্ক কয়েকজন লেখকের সঙ্গে ‘মুক্তমনা’ নামে লেখালেখির একটি ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে তিনি বিজ্ঞান, ধর্ম, নাস্তিকতাবাদ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ইত্যাদি বিষয়ে লেখালেখি করতেন। তাঁর লেখার বিষয়বস্তুর জন্য গোঁড়া ইসলামপবীদের দ্বারা বিশেষভাবে সমালোচিত ছিলেন অভিজিৎ রায়। ২০১৪ সালে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামক বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে তাঁর উপর মৌলবাদীদের ক্ষোভ বাড়ে। তাঁরা অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার হুমকি দিতে থাকেন নিয়মিত।
কিন্তু মৌলবাদীদের হত্যার পরোয়ানা সত্ত্বেও প্রিয় বাংলাদেশকে দেখতে এসেছিলেন অভিজিৎ রায়। এসেছিলেন অসুস্থ মা-বাবাকে দেখতে, বইমেলায় প্রকাশিত নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে, বাংলাদেশের বাতাসে প্রাণভরে শ্বাস নিতে। তিনি এসেছিলেন অতিথি হয়ে। কিন্তু জানতেন না, তাঁর প্রিয় বাংলাদেশ বদলে গিয়েছে। তাঁর চতুর্দিকে পাতা আছে মৃত্যুর ফাঁদ। কিন্তু নিজের মাটির উপর ছিল তাঁর বিশ্বাস। তাই মৃত্যুর তিন দিন আগেও তাঁকে দেওয়া হুমকি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আমি লেখক মানুষ, আমাকে কেন মারবে?” কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি তাঁর এই আস্থা শেষপর্যন্ত মিথ্যে প্রমাণিত হয়।
বাংলাদেশের বইমেলা থেকে বেরোনোর পর দুষ্কৃতীরা প্রাণঘাতী আক্রমণ হানে তাঁর উপর। হাসপাতালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর চলে যেতে হয় অভিজিৎ রায়কে।
আসলে এটাই প্রথম নয়। বাংলাদেশে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের বছর কয়েক আগে ২০১৩ সালে প্রথম খুন হন ব্লগার রাজীব হায়দার। দু-বছর পর অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমেই মূলত ব্লগার বা লেখক হত্যা শুরু হয়। অভিজিৎ রায়ের হত্যার একমাস পরই ৩০ মার্চ খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু।
ওই বছরে এভাবে মোট পাঁচ জন বাংলাদেশি ব্লগার, লেখক কিংবা প্রকাশক হত্যাকান্ডের শিকার হন। পরে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী এসব হামলার দায় শিকার করে। যদিও পরের বছরও এই হত্যালীলা অব্যাহত থাকে। ব্লগার নাজিমুদ্দীন সামাদ এবং সমকামী অধিকার পত্রিকা ‘রূপবান’-এর সম্পাদক জুলহাজ মান্নান খুন হন এপ্রিল মাসে। দুঃখের বিষয় এটাই যে-হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায়, রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর বাবু, নিলয় নীল, অনন্ত বিজয়, দীপন এরকম অনেক নক্ষত্রের অপমৃত্যুর সাক্ষী হতে হয়েছিল আপামর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে। এর রেশ সমগ্র বাংলাকে উত্তাল করে তুলেছিল, তার আঁচ এসে পৌঁছেছিল কলকাতাতেও।
ক্রমাগত ঘটে যাওয়া এই নির্মম লেখক হত্যার ঘটনাগুলি কবি শ্রীজাতর মনেও প্রবলভাবে প্রভাব ফেলেছিল। একজন কবির প্রতিবাদ, ক্ষোভ, মনের ভাব সবকিছুই প্রতিফলিত হয় তাঁর লেখনীতে। সেইরকমই এই সংকটকালের যন্ত্রণা, পীড়া কবি শ্রীজাতর লেখনীতেও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (২২ জানুয়ারি, ২০১৬) তিনি বলেছিলেন-“পেশোয়ারে ১৭৬ জন বাচ্চাকে যখন হত্যা করা হয় তখন হতাশার সলো রাগ হয়। যখন ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয় তখন হতাশা গ্রাস করে। ইনফ্যাক্ট অভিজিৎ রায়ের পরেই তো ‘অনধকার লেখাগুচ্ছ’ লিখতে শুরু করলাম।”
তাঁর কথার এই সূত্র ধরে বলা যায় দীর্ঘদিন ধরে ঘটে চলা নানা অনভিপ্রেত ঘটনা, হত্যা আর অবিশ্বাসে ভরা সমাজে, রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে এক মৃত্যু উপত্যকাসমান অনিশ্চয়তার মধ্যে জন্ম হয় ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’-এর মতো লেখার। এই লেখা আসলে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিক খুঁজে নিতে নির্দেশ দেয়, মানুষকে ভাবিয়ে তোলে, তাকে প্রশ্ন করতে শেখায়। এই লেখা পাঠককে বাঁচার সাহস যোগায়।
বিষয়বস্তু
প্রকৃত ধর্ম হল মানুষের নিজস্ব কর্মের এক শাশ্বত যাপন। কবি, কৃষক, চিকিৎসক, শ্রমিক, সংগীতশিল্পী, দার্শনিক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী প্রত্যেক কর্মক্ষম মানুষই তাঁদের নিজের নিজের কর্মযজ্ঞে সিদ্ধিলাভকরার চেষ্টা করেন। তাঁদের কর্মের কাছে সমাজের পালনীয় আচার-ধর্ম কখনোই প্রাধান্য পায় না। আবার সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য, সমাজকে আলোর পথে চালনা করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পরিচয়ও তাঁদের বহন করতে হয় না। কাজই হয়ে ওঠে তাঁদের সাধনা, কাজই হয়ে ওঠে তাঁদের পরিচয়।
যেমন-শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী আবদুল করিম খাঁ-এর সাধনা ছিল গান। গানের জগৎই তাঁকে বিখ্যাত করেছে গোটা বিশ্বের কাছে; বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর বিজ্ঞানচেতনার দ্বারা, নিত্যনতুন আবিষ্কারের দ্বারা জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন। তেমনই কবীর তাঁর দর্শন প্রতিভায় খ্যাত হয়েছেন, ভ্যান গঘ তাঁর চিত্রশিল্পে দক্ষতার কারণে আজও বিশ্বনন্দিত, কবিতার মাধ্যমে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন গার্সিয়া লোরকা। আবার লেনিনের সংগ্রামী চেতনা সর্বদাই মানুষকে ভাবিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তাঁদের কাজ, বিশ্বাস, সাধারণ মানুষের জন্য অভিনব কিছু করার প্রচেষ্টাই হয়ে উঠেছে তাঁদের ধর্ম।
এই প্রসঙ্গেই কবি শ্রীজাত মনুষ্যধর্মের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রকৃতির। বিশ্বনন্দিত এই ব্যক্তিত্বদের ধর্ম যেমন কোনোরকম ভেদাভেদের সীমানায় আবদ্ধ না হয়ে, তাঁদের কর্মকে সমগ্র বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া-বাতাসের ধর্মও যেন তাই। বাতাস কোনো বাঁধাধরা গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে চায়। যেখানে দেশ-কাল-সীমানার কোনো বেড়াজাল থাকে না। আবার, আগুন যেমন তার লেলিহান শিখা দ্বারা যা কিছু জীর্ণ, কলুষিত তা পুড়িয়ে দিতে চায় নিমেষে। তেমনই এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাও চেয়েছেন প্রতিবাদের আগুনে সমাজের ধর্মান্ধতার প্রাচীর জ্বালিয়ে ফেলে মানবধর্মকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে।
কবি তাই তাঁর পাঠকদের উদ্দেশে বলেছেন, প্রকৃতির এই নানাবিধ ধর্ম তাদের বিভিন্নতা নিয়েই একই গ্রহে থাকে। তারা কেউই একে অপরের প্রতি অসহিষ্ণু নয়, বরং তারা একে অপরকে বিস্তারলাভের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়। সাধারণ মানুষের কাছে মানবতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাই পৃথিবীর যে অংশে মানুষ সহিষ্ণুতার ভাবনাই ভাবতে চায়, সকলে মিলেমিশে একসঙ্গে থাকতে চায় সেখানেই হয় প্রকৃত ধর্মের বাস। তবে সেখানেও দেখা যায় একদল মানুষ মিথ্যা ধর্মের মোহে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য হিংসা, হানাহানি ছড়িয়ে দিতে চাইছে।
এই হিংসাত্মক ধর্ম কেবলই মানুষকে শেখায় হিংসায় মেতে উঠতে-সবকিছু ধ্বংস করে দিতে। তাই কবি বলেছেন, এই ধ্বংসের মানসিকতা আসলে কোনো ধর্মই নয়। ধর্মের ধ্বজাধারী মানুষের এই হিংস্র মানসিকতা আসলে প্রাতিষ্ঠানিকতা-যা মানুষের মধ্যে কেবল ভেদাভেদ তৈরি করতে চায়। চায় সমাজকে আরো কলুষিত করে দিতে। যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য।
আরও পড়ুন : আদরিণী গল্পের MCQ প্রশ্ন উত্তর
আরও পড়ুন : বাঙ্গালা ভাষা প্রবন্ধের MCQ