আধুনিক জীবনে কম্পিউটার রচনা

আধুনিক জীবনে কম্পিউটার রচনা
আধুনিক জীবনে কম্পিউটার রচনা

ভূমিকা

বিশ্বায়নের প্রভাবে আধুনিক মানুষ যতই যন্ত্রনির্ভর হচ্ছে ততই বিজ্ঞানের নব নব দিক তার আঙিনায় এসে উপস্থিত হচ্ছে। মধ্যযুগীয় জীবনচেতনা থেকে আধুনিক জীবনবোধে যে অগ্রগতি তার মূলেও আছে বিজ্ঞানমনস্কতা। মানুষের সেই বিজ্ঞানমনস্কতার নবতম সাফল্য কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি। বিশেষ করে আধুনিক জীবনে এইসব উপাদান জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তবে একথাও সত্য যে, এই অপরিহার্যতা মানুষকে ক্রমশ যান্ত্রিক ও কৃত্রিম করে তুলছে। যে যান্ত্রিকতা দূর করার জন্য শিল্পবিপ্লবের পর কম্পিউটার সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তা-ই আবার মানুষকে যান্ত্রিক করে তুলছে অতিরিক্ত যন্ত্র-নির্ভরতা ও ভুল প্রয়োগের কারণে। তাই বিজ্ঞানের বিস্তারকে কাজে লাগাতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন কম্পিউটারের কুফলগুলির কথা মনে রেখে তার সুফলগুলির সার্বিক ও যথাযথ রূপায়ণ।

কম্পিউটারের কাজ ও প্রয়োজনীয়তা

কম্পিউটারের কাজ অনেকটা মানুষের মগজের কাজের মতো। এর স্মৃতি ভাণ্ডার আছে-যেখানে দুটি জিনিষ সংরক্ষিত রাখতে হয়। প্রথম, কোন একটি বিশেষ সমস্যা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য, যার দ্বারা কম্পিউটার কাজ করবে, দ্বিতীয় সেই বিশেষ সমস্যা সমাধানের একটা ক্রমবিন্যস্ত পদ্ধতি, যে ক্রমবিন্যাস অনুযায়ী কাজ করবে। স্মৃতিতে কি কাজ হবে এবং কিভাবে তা হবে-এই দুটি বিষয় থাকে। প্রথমটিকে বলা হয় তথ্য, দ্বিতীয়টিকে বলা হয় প্রোগ্রাম। আবার তথ্য ও প্রোগ্রামের রদবদল ঘটিয়ে একই কম্পিউটার দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন কাজ করার সুযোগ থাকে। কম্পিউটারের প্রয়োজনীয়তার মূল কারণ চারটি: (ক) দ্রুত গণনা করার ক্ষমতা, (খ) বিপুল তথ্যকে সুসংবদ্ধভাবে সংরক্ষণ করার ক্ষমতা, (গ) ত্রুটিহীনতা এবং (ঘ) তথ্য ও প্রোগ্রাম অনুযায়ী যথাযথ কাজ করার ক্ষমতা।

কম্পিউটার ও আধুনিক জীবন

ব্রিটিশ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজের গণকযন্ত্রের আবিষ্কার কম্পিউটার নির্মাণে প্রেরণা যুগিয়েছিল। সেই কম্পিউটার এখন আধুনিক জীবনের বহুক্ষেত্রে বিস্তৃত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কম্পিউটারের অপরিহার্যতা চোখে পড়ার মতো। কেননা তা আজ মানুষের কাছে নির্ভরশীল বস্তুর মতো। যে কোনো বাণিজ্যিক সংস্থায় হিসাবনিকাশ করতে এবং সেই হিসাবনিকাশ যথাযথভাবে রক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে কম্পিউটারের জুড়ি নেই। মানুষের বুদ্ধির সঙ্গে কম্পিউটারের ক্রিয়াকলাপ তুলনীয়। মানুষের স্মৃতির মতো কম্পিউটারেরও স্মৃতিভাণ্ডার রয়েছে। এর দ্বারা কোনো একটি বিশেষ সমস্যা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এবং সমস্যা সমাধানের ক্রমবিন্য স্ত পদ্ধতি রক্ষিত থাকে।

কম্পিউটার যেন সবজান্তা মেসিন, তা উৎসুক মানুষের কাছে পরম বন্ধু। ভূত ভবিষ্যতের এবং বর্তমানের হাজারো প্রশ্নের জবাব কম্পিউটারের কাছে পাওয়া যায়। কম্পিউটার বড় বড় কলকারখানা ও তার রূপায়নের কাজ করছে, রেলওয়ে, এয়ার লাইন্স, পোস্ট এ্যান্ড টেলিগ্রাফ, ব্যাঙ্ক, রিসার্চ সেন্টার, ইনসিওরেন্স, স্টক মার্কেট সর্বত্রই কম্পিউটারের আধিপত্য। পরীক্ষার ফলপ্রকাশ, অপরাধীকে খুঁজে বার করা, পাত্র-পাত্রী নির্বাচন, পুরোনো মামলা সংক্রান্ত নথিপত্র খোঁজা প্রভৃতি কোনো কাজই আজ কম্পিউটারের কাছে দুরুহ নয়। আধুনিক জীবনে কম্পিউটার তাই নিত্যসঙ্গী।

সুফল

সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, কম্পিউটারের ব্যবহার বিভিন্ন ধরনের কাজকে আরও সহজ ও সাবলীল করে তুলেছে। কম্পিউটারের তথ্য সংরক্ষণ ক্ষমতা বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির নানা গবেষণায় ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা বহন করে নিয়ে এসেছে। পরীক্ষার ফলপ্রকাশ থেকে শুরু করে অফিসের বিভিন্ন কার্যাবলী আজ কম্পিউটারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। কম্পিউটার চালিত ‘স্ক্যারাব’ খুঁজে এনেছিল আটলান্টিক মহাসাগরে ভেঙে পড়া বিমানের ‘ব্ল্যাকবক্স’। কম্পিউটার চালিত রোবোট কলকারখানায় গতানুগতিক ও রুটিন কাজকর্মের দায়িত্ব নিয়েছে। যে সব দুরূহ কাজ মানুষের অসাধ্য, যে স্থানে মানুষ যেতে পারে না, যে কাজ মানুষের কাছে একঘেয়ে-এমন সব কাজই কম্পিউটার করে দিতে পারে অনায়াসে।

কুফল

কম্পিউটারের ব্যবহারে ইতিমধ্যে সরকারি কার্যালয়ে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে, আদালতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এভাবে কর্মীসংখ্যা হ্রাস পেতে পেতে দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। যন্ত্রনির্ভর সভ্যতা মানুষকে করবে যান্ত্রিক আর যান্ত্রিক মানুষ হয়ে যাবে নিঃসঙ্গ, সেই নিঃসঙ্গতার বেদনা সহ্য করা মানুষের পক্ষে খুব কঠিন হবে। তাছাড়া কম্পিউটার যারা সবসময় ব্যবহার করেন, সেইসব কর্মীরা নানা রোগের শিকারও হতে পারেন বলে অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইন্টারনেট

কম্পিউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেট, ই-মেল সার্ভিস পাওয়া যায়। ইন্টারনেট হল এমন একটা প্রক্রিয়া যার দ্বারা নিজের বাড়িতে বসে নিজের পছন্দমতো যে কোনো জিনিস বা বিষয়ের খবর পাওয়া যায়। যেমন, ট্রেনের টিকিট কাটার দরকার? শুধু কম্পিউটারটা নিয়ে বসলেই হল। আর ই-মেল হল দূর-দূরান্ত থেকে কোনো খবর পাঠাবার ক্ষেত্রে উপযুক্ত মাধ্যম। এই দুই পরিষেবায় প্রযুক্তিগত কৌশল এত উচ্চমানের যে, আয়কর বিষয়ে পরামর্শ থেকে বিদেশে পড়তে গিয়ে কি সমস্যায় পড়তে হতে পারে, তার সমাধান পর্যন্ত পেয়ে যাওয়া যায়। ইন্টারনেট পরিষেবায় ‘এডুকেশন’ শব্দটা টাইপ করলেই পেয়ে যাওয়া যায় অক্সফোর্ড থেকে আই. আই. টি., বিশ্বজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একগাদা নাম। শুধু শিক্ষা নয়, পাত্র-পাত্রী, চাকরি-বাকরি, জ্যোতিষ, আইনি পরামর্শ, ডাক্তারি যে কোনো পরিষেবা পাওয়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্ভব। আজকের একজন শিক্ষার্থী প্রয়োজন মনে করলে গত দশ বৎসরের যে কোনো বিষয়ের প্রশ্ন, তার উত্তর সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যেতে পারবে। 

ইন্টারনেটের কুফল

ইন্টারনেটের কুফলও আছে। একজন অনুসন্ধিৎসুর অজানাকে জানবার যে ইচ্ছা সেই ইচ্ছা বা কৌতূহল ক্রমশ কমতে থাকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কারণ যন্ত্র তো যন্ত্রই, তার যান্ত্রিকতা একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে ক্রমশ একঘেয়ে ও ইন্টারনেটের কুফল নিরানন্দ করে তোলে। কম্পিউটার হোক্ কিংবা ইন্টারনেট হোক তাকে চালাবে যে বুদ্ধি, সেই বুদ্ধি যদি ঠিকপথে পরিচালিত না হয় তাহলে বিজ্ঞানের সুফল পাওয়া যাবে না। 

উপসংহার

ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার আধুনিক জীবনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। কিন্তু যেখানে বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে, যারা স্বল্পশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত তাদেরকে যদি কম্পিউটারের আওতায় আনা না যায়, তাহলে সভ্যতার তলায় যে তলানি পড়বে তার দায় গিয়ে পড়বে আধুনিক জীবনের ক্ষেত্রে। আসলে আমাদের দেশে সব কিছু বিজ্ঞানের সুফল এখনো মুষ্টিমেয় মানুষের করায়ত্ত, তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে গ্রামের প্রান্তে থাকা একজন সাধারণ মানুষের কাছে, তবেই কম্পিউটারের সার্বিক সাফল্য আমরা পেতে পারব।

Leave a Comment